
তখন সবে মাত্র শাহিন কলেজ থেকে এস এস সি পাস করে আমি আদমজী কলেজে ভর্তি হয়েছি .
শাহিনে আমাদের সবার প্রিয় ক্লাস মেট ছিল শুচি।
শুচি! কি অদ্ভুত মায়া মাখা স্নিগ্ধ মেয়েটি, এক মিনিট কথা বললেই মনে হত, আমার যদি এমন একজন বোন থাকতো. সদা হাস্যমুখি শুচি, কাউকে শুনিনি তার প্রেমে পরেছে, অথচ সবাই তাকে গভীর মমতায় ভালোবাসতো।
জীবন কি, তখনও না বুঝলেও, মৃত্যু কি, আমরা তখন বুঝি।
কলেজের নতুন রঙিন জীবন শুরু । অথচ একদিন শুচি ক্লাসে এলোনা, শুধু খবর এলো, শুচির ক্যান্সার হয়েছে। বাঁচানো যাবে। প্রাথমিক চিকিৎসা চলছে। আরো চল্লিশ লাখ টাকা লাগবে তাকে সুস্থ করতে।
তখনকার দিনে চল্লিশ লাখ অনেক টাকা। শুচির মা আমাদের ম্যাডাম। তাদের মেয়েকে বাঁচাতে হবে, কিন্তু এত টাকা নেই। ভিক্ষা চাওয়ার মত সামাজিক অবস্থানও নেই।
তখন ফেইসবুক ছিল না, বিটিভি ছাড়া কেবল ছিল ইটিভি। আমরা শুচির ভাইয়েরা ঝাঁপিয়ে পরলাম। শুচিকে বাঁচাতে হবে। যেভাবেই হোক, টাকা লাগবে।
পড়াশোনা বাদ, নাওয়া, খাওয়া, ঘুম, ক্রিকেট বাদ, শুচিকে বাঁচাতে হবে। ১৩ কোটি মানুষের ৪০ লক্ষ জন এক টাকা করে দিলেই হয়ে যায়।
আমরা ঝাঁপিয়ে পরলাম, তবে অন্ধকারে, কেউ জানিনা কি করতে হয়। ক্যান্টনমেন্টের ছেলে- মেয়ে হওয়ায় বাইরের দুনিয়া একটু কমই চিনতো সবাই, বরং আমিই তখন ঢাকা শহর পুরোটা চিনি।
শুরু হোল ক্যাম্পেইন, ক্যান্টনমেন্টের সব স্কুলে চাঁদা তুললাম, আমার মনে আছে। আমি শহীদ আনোয়ার গার্লস স্কুলের গেইটে একটা সাদা কাপড় হাতে চাঁদা তোলার জন্য দাঁড়িয়ে থাকতাম, প্রিন্সিপাল অনুমতি দেয়নি, তাই গেইটেই দাঁড়িয়ে থাকতাম, মেয়েরা ২-৫ টাকা দিত। দিন শেষে আমি স্কুল ব্যাগ ভর্তি ভাংতি ছেঁড়া টাকা গুলি নিয়ে বাসায় ফিরতাম, অনেক গুলি নোট মিলে অল্প কিছু টাকা হতো। শুচির অবস্থা খারাপ হতে থাকলো, সাথে আমাদের কনফিডেন্টও।
বন্ধু আরিফ জান টাও দেয়া বাকি রাখলো। আমরা পত্রিকায় সাহায্যের আবেদন করলাম, ইটিভি তে আমি আর আরিফ গিয়ে নিউজ করলাম, টি এস সি তে র্যালি করলাম, মঞ্চ নাটক হোল, যার পুরো টাকা টা আমাদের দিয়ে দিলেন ঢাকা ভার্সিটির ভাইয়া-আপুরা। ট্রাক ভাঁড়া করে ঢাকা শহর ঘুরে ঘুরে মাইকিং করে আমরা টাকা তুলতে লাগলাম।
শুচির চুল পরে গেলো কেমো থেরাপির পরে। সেই স্নিগ্ধ অপরূপা শুচি, আজ অন্য কিছু। আমাদের দেখলে কাঁদে না, এমন ভাবে হাসে, যেন মৃত্যুও তার কাছে এসে থমকে যায়।
আমরা দমলাম না। এবার গেলাম কয়েকটি ব্যান্ডের কাছে। মাইলস, এল আর বি। প্রতিশ্রুতি পেলাম, তাদেরকে টাকা দিতে হবে না। ধানমণ্ডিতে পোস্টার লাগিয়ে ভরে ফেল্লাম। রাশিয়ান কালচারাল সেন্টারে কনসার্ট হবে। টিকেটের টাকা শুচির জন্য।
কনসার্টের দিন আমরা প্রবল আগ্রহে অপেক্ষা করছি, কিন্তু মাত্র অল্প কিছু ছেলে-মেয়ে এলো। আমার কান্না চলে এলো, যত টুকু মনে পরে, মাইলস গান করলো না, দর্শক নেই। ( আমি মনে করতে পারছি না ) বাচ্চু ভাই এলেন। অনেক আবেগ ভরা কণ্ঠে অনেক গুলি কথা বললেন। ধানমণ্ডির সেই ধনীর দুলাল দের শুচির জন্য এগিয়ে আসতে বললেন।
শ্রোতা ছিল না, তবুও শুধু গিটার হাতে বাচ্চু ভাই ৩-৪ টা গান শুনালেন।
আইয়ুব বাচ্চু, তখন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে, এতই জনপ্রিয় যে তার সাথে কথা বলেছি বলেও বন্ধু মহলে প্রবল ভাব নেয়া যেতো। সারা বছর তার কনসার্ট। দেশের সর্বোচ্চ সন্মানি দিয়েও ছয় মাস আগে থেকে বুকিং দিয়েও তাকে পাওয়া যায় না। আমরা কিভাবে পেলাম??
ওনার ব্যান্ডের একজন বললেন, চিটাগাঙে এল আর বির কনসার্ট ছিল দুই লক্ষ টাকার ( তখন এটাই অনেক টাকা )। বাচ্চু ভাই সেটা কেন্সেল করেছেন। শুচির সাহায্যের জন্য ঢাকায় থেকে গেছেন।
ব্যাক স্টেজে খাম ভর্তি টাকা দিয়ে আমাদের কে মাথায় হাত দিয়ে নিজের চোখ মুছে বাচ্চু ভাই বলে গেলেন, " যে বোনের এতগুলি ভাই, সে বোন কখনও মরে না "
কাঁদতে কাঁদতে বাসায় ফিরেছি সে রাতে ।
আমরা ১৬-১৭ বছরের কত গুলি অকাজের ছেলেমেয়ে ৪০ লক্ষ টাকা তুলে ফেললাম।দিন গড়িয়ে মাস গেল.
আমাদের ঘামে ভেজা কলেজের শার্ট আর অশ্রু ভেজা চোখ গুলিকে সাক্ষী রেখে একদিন শুচি চলে গেলো. আমাদের ভালবাসার শুচি, আমাদের সবাইকে ছেড়ে, চিরতরে। অসংখ্য খুচরো টাকা গুলি পৃথিবীর মায়ায় পরে রইলো ব্যাঙ্কে। আর বুকে জমে রইলো শুচির ছোট ছোট অপূর্ণতার স্মৃতি। আর আমাদের বুকে জড়িয়ে ম্যাডামের মেয়ে হারানোর বিদীর্ণ চিৎকার।
আজও গভীর রাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলে বুক হাহাকার করে উঠে। এত গুলি ভাই মিলে একটা মাত্র বোন শুচিকে আমরা ধরে রাখতে পারিনি।
দেড় যুগ পরে প্রিয় বাচ্চু ভাইও চলে গেলেন। ১৮ কোটি ভক্তকে ভালবাসায় কাঁদিয়ে.
ভালোবাসারা এভাবেই চলে যায়, বুক খালি করে দিয়ে .
এস এম আমিনুল রুবেল.
সিডনী
২৩ অক্টবর ২০১৮