প্রতিটি দেশেই জনসংখ্যার উপর নির্ভর করে তাদের খাদ্যের চাহিদা মেটানোর জন্য কৃষি জমি গুলো গড়ে উঠে। বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ কৃষির উপর নির্ভর করে বেঁচে আছে। প্রতিনয়ত এই দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে কিন্তু ভূমির পরিমাণ এর কোন পরিবর্তন হচ্ছে না। আগামী ২০২০ সালের মধ্যে এই দেশের জনসংখ্যা হবে ২০০ মিলিয়ন কিন্তু প্রতি বছর ৬০০০ বিঘা জমি এই বিপুল পরিমাণ জনগোষ্ঠীর বাস্থান নগরায়ান ও ভূমি ক্ষয় এর কারনে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও জলবায়ু ও অন্যান্য কারনে এই দেশের কৃষির উপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের এক প্রতিবেদন বলছে, মানসম্পন্ন মাটিতে ৩.৫ শতাংশের বেশি জৈব পদার্থ থাকা প্রয়োজন। কিন্তু বর্তমানে দেশের বিভিন্ন এলাকার বেশির ভাগ ফসলি জমির জৈব পদার্থ কমে দাঁড়িয়েছে ১.৭ শতাংশের নিচে। এমনকি বহু জমিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ ১ শতাংশেরও নিচে নেমে গেছে। দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে মাটির লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ার কারণে ১০ লাখ হেক্টরেরও বেশি জমি বন্ধ্যা হওয়ার পথে। ১৯৭৩ সালের জরিপে যেখানে লবণাক্ত মৃত্তিকার পরিমাণ ছিল ৮ লাখ ৩৩ হাজার হেক্টর, বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ লাখ ২০ হাজার হেক্টরে। লবণাক্ততা বাড়ার পরিমাণ ২৫.৫ শতাংশ। অপরদিকে যশোর, নড়াইল, গোপালগঞ্জ ও মাদারীপুরের কিছু জৈব মাটির বিল অঞ্চলে বর্তমানে ফসল উৎপাদন একেবারে সীমিত হয়ে পড়েছে। দেশি ও উফশী রোপা আমন ছাড়া সেখানে আর কিছুই চাষ হচ্ছে না। মৃত্তিকাবিজ্ঞানীরা মনে করছেন, দ্রুত সমন্বিত ব্যবস্থায় শস্য নিবিড়তা না বাড়ানো হলে অচিরেই এসব এলাকার পুরো জমির লবণাক্ততার হার মাত্রাতিরিক্তভাবে বেড়ে যাবে এবং এখানে আর কোনোদিনই সবুজ শস্য জন্মাবে না।
এই পরিসংখ্যান দেখে মনে হতে পারে, শুধু দক্ষিণাঞ্চলেই বুঝি আবাদি জমির পরিমাণ কমছে। আসলে তা নয়। সারা দেশেই আবাদি জমির পরিমাণ কমছে। ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদফতরের তথ্যমতে, ১৯৭১ সালে দেশে মোট আবাদি জমির পরিমাণ ছিল ২ কোটি ১৭ লাখ একর। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যমতে, ১৯৮৪ সালে দেশে মোট আবাদি জমির পরিমাণ ছিল ২ কোটি ২ লাখ ৩৮ হাজার একর। ১৯৯৭ সালে কমে এসে তা ১ কোটি ৭৪ লাখ ৪৯ হাজার একরে দাঁড়ায় এবং ২০১২ সালে দেশে আবাদি জমির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ কোটি ৫৪ হাজার একরে। যার ফলে এই বিপুল পরিমাণ মানুষের খাদ্যের চাহিদা কিভাবে মেটানো হবে তা প্রশ্নের মুখে।
তাই দেশের এই বিপুল পরিমাণ মানুষের খাদ্যের চাহিদা মেটানোর জন্য আমাদেরকে কৃষিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে। আর এর জন্য কৃষির সবচেয় বড় উপাদান মাটির গুনাগুন সম্পর্কে কৃষকদের জানতে হবে ও মাটি পরিক্ষার ব্যাপারের সচেতন হতে হবে, কারন একমাত্র মাটি পরীক্ষা করে ফসল উৎপাদন না করলে কাঙ্খিত ফলাফল পাওয়া সম্ভব না এছাড়াও ভুল মাটিতে ভুল ফসল চাষ করলে মাটির পুষ্টি উপাদান খুব দ্রুত নষ্ট হয়।
পোর্টেবল সয়েল টেস্টিং ডিভাইস – যার সাহায্যে একজন কৃষক তার ফসলের মাঠে বসেই মাটি পরীক্ষা করে ফসলের মাঠের অবস্থা সম্পর্কে জানতে পারবেন।
বর্তমানে ফসলের মাঠের মাটি পরীক্ষার যে জন্য যে পদ্ধতি মানা হয় তাতে রয়েছে অনেক ঝক্কি ঝামেলা। কৃষক মাঠ হতে মাটির নমুনা সংগ্রহ করে ল্যাবে নিয়ে যেতে হয় এর পর একটি নিদিষ্ট ফি এর বিনিময়ে তার নমুনা মাটিটি দিয়ে আসেন পরীক্ষার জন্য, পরীক্ষার ফলাফল আসতে সময় লাগে ২৫-৩০ দিন। কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পাওয়ার জন্য কৃষককে অনেক দিন অপেক্ষা করতে হয় বলে তার ফসল উৎপাদন ব্যাহত হয়, ফলে উৎপাদন ব্যায় বৃদ্ধি পায়।
বর্তমানে একজন কৃষককে মাটি পরীক্ষার প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ করতে সময় নিতে হয় ২৫-৩০ দিন এবং খরচের পরিমান ৫০০-৮০০ টাক। এছাড়াও ল্যাবে তাকে কমপক্ষে ৫ বার ভিজিট করতে হয়। এসব ঝামেলা এড়াতেই তৈরি করা হয়েছে পোর্টেবল সয়েল টেস্টিং ডিভাইস। অতি স্বল্প মুল্যেই কৃষক এ যন্ত্রটি কিনতে পারবেন। মাটি পরীক্ষার পদ্ধতি আরো সহজ, কম সময় ও কম খরচে করার উদ্দেশ্যই মাটির প্রাণ নামক এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য। প্রকল্পটির সহযোগিতায় ছিলেন ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশ।
যেভাবে কাজ করে মাটির প্রাণ -
কৃষক ডিভাইস টি নিয়ে মাঠে আসবেনে এবং জমি কে ৯ টি ব্লকে চিহ্নিত করে মাটির নমুনা সংগ্রহ করবেন। আর্দ্রতা পরিমাপক সেন্সর কে মাঠের মাঝামাঝি স্থাপন করে মাটির আদ্রতার মান নেয়া হবে। সংগৃহীত নমুনা মাটি হতে দ্রবণ তৈরি করা হবে এবং সেই দ্রবণে phসেন্সর এর মাধ্যমে মাটির Phএর মান বের করা হবে। মাটি হতে প্রাপ্ত তথ্য গুল একটি মোবাইল অ্যাপে ইনপুট দেওয়া হবে। মোবাইল অ্যাপটি সম্পূর্ণ বাংলায় তৈরি করা ফলে একজন কৃষক খুব সহজে এটি ব্যাবহার করতে পারবেন। অ্যাপটি ইনপুটকৃত তথ্য গুলোকে বিশ্লেষণ করে মাটির বর্তমান অবস্থা, পুষ্টি উপাদান, কি পরিমাণ সার দিতে হবে এবং ওই মাটিতে কি ফসল ভাল হবে তা বলে দিবে।
আমাদের দেশের ৪৬.৬ ভাগ মানুষ কৃষির সাথে জড়িত এদের মধ্যে বিশাল একটা অংশ তাদের পূর্ব অভিজ্ঞতা দিয়ে কৃষি কাজ করে যাচ্ছে। এদের টেকনোলজি সম্পর্কে ধারনা খুবই কম, যার ফলে জমিতে অধিক মাত্রায় সার ও কীটনাশক ব্যাবহার হচ্ছে এতে খাদ্যের গুনাগুন নষ্ট হচ্ছে এবং কৃষকের ফসল উৎপাদন ব্যায় অনেক বেড়ে যাচ্ছে।
যেহেতু এটি সম্পুর্ণ প্রযুক্তি নির্ভর একটি প্রকল্প। তাই যে কৃষক ডিভাইসটি কিনবেন তাকে আমাদের পক্ষ থেকে প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করা হবে। আমরা আশা করছি আমাদের মাটির প্রাণ প্রকল্পের মাধ্যমে উদ্ভাবিত সয়েল টেস্টিং ডিভাইস কৃষিখাতে এক অনন্য অবদান রাখবে।