29/08/2024
পাইকগাছার বন্যার্তদের সাথে কাজ করে এসে,
ভেবেছিলাম এসেই পরেরদিন লিখে সবার সাথে শেয়ার করবো, কিন্তু শরীর আর দিচ্ছিলো না। তাহলে বলি,
প্রথমত, মানুষের কষ্ট আর দিনযাপনের যে সীমাহীন দূর্ভোগ, তা বন্যা কবলিত এলাকায় না গেলে বুঝবেন না। পাইকগাছার নদীর পাড়ে ওয়াপদা বলে যে জায়গাটা সবাই জানে, ওইখানে প্রায় ৫৬ ঘর পরিবার নিয়ে আছে। এদের সবার বাড়িই বলা যায় এ বন্যার সময় থাকা অনুপোযোগী। কারো কারো প্রায় পুরো ঘরটায় পানির নিচে, কারো মাটির ঘর ভেংগে পরেছে। কিন্তু বেশ কিছু পরিবার এখনো যার যার বাড়িতে অবস্থান করছে, তাদের ঘরগুলো হয়তো একটু উচুতে বা ইটের। তাই বলে যে তারা ভালো আছে, তা না। আমার মনে হয়েছে, তারা বেশি কষ্টে আছে-এ কথাটায় একটু পরে আসছি।
এরপর ভালো লাগার যে ব্যাপারটা, প্রচুর ত্রাণ ইতিমধ্যে সেখানে গেছে, অনেক মানুষ দিনরাত কাজ করে যাচ্ছে। সুপেন্দু আর দুর্জয় নামের যে দুইজন ছেলের সাহায্যে আমরা কাজ করেছি, আমি তাদের স্যালুট জানাই। দুর্জয় ছেলেটা আমার সাথে সাথে বুক-গলা সমান পানি নেমে নেমে কাজ করে গেছে। মাত্র এইচ এস সি তে পড়ে ছেলেটা, কি কাজের স্পৃহা!
যারা ত্রাণ নিয়ে যাচ্ছে, অনেককেই দেখেছি নদীর পাড়ে গিয়ে নৌকা থামিয়ে ত্রাণ দিয়ে চলে আসতে। হয়তো এক এক জন করে নিয়ে গেছে আবার অন্য নৌকা দেখলাম স্থানীয় কোন একজনকে ৮০-৯০ প্যাকেট বুঝায় দিয়ে গেলো, যেনো সবাইকে দেয়া হয়। এটা আরেকটা ভুল। এটার কারণে দুইটা সমস্যা হচ্ছেঃ (১) ওয়াপদা বা বাধের উপর যারা আছেন, শুধু তারাই পাচ্ছেন, ভেতরে অনেক পরিবার আটকে আছে, তারা পাচ্ছেন না, (২) একজনকে যখন বিতরণের কাজ দেয়া হচ্ছে, সেখানে অসম বন্টন হচ্ছে।
বিদ্যালয়, কলেজ-তথা সেল্টারগুলোতে যারা আশ্রয় নিয়েছে, তারা সাহায্য পাচ্ছে, কিন্তু যারা গ্রামের ভেতরে ভেতরে ঘরবাড়িতে আটকে আছে বা লজ্জায় কারো কাছে চাইতে ও পারছে না-তারা বড় ঝামেলায় পরছে। আমি, এমরান, সাব্বির আর দুর্জয় প্রায় বুক সমান পানি পার হয়ে যখন একটা বাড়িতে পৌছায়, দেখি যে একজন মহিলা দরজ়ায় দাঁড়িয়ে আছে, তার একটা হাতে প্লাষ্টার। আসার সময় দুর্জয় বলছিলো, “স্যার, এই একটা বাড়িতে ত্রাণ দিতে পারার পর মনে হয়েছে, আমরা আসলেই ত্রাণ দিয়েছি”। যারা যাচ্ছেন বা যাবেন, যেখানেই যান, স্থানীয় লোকজনের সাহায্যে একটু ভেতরে ভেতরে গিয়ে দিয়ে আসতে পারলে ভালো হয়। এমরানের বাক্যে, এটাই তো এই কাজের সার্থকতা।
আপনি যখন কাজে যাবেন, আপনাকে একটু ঝুকি নিতে হবে, তাই নিজেকে সেভাবে প্রস্তুত রাখাটা দরকার। নৌকা থেকে নামতে গিয়ে, সবাই ভিজে যায়, তারপর ও পানি পার হয়ে হয়ে সবাই কাজ করে গেছে। এইযে কথাগুলা, এগুলা শুনতে যতটা সহজ, বাস্তব তার থেকে ও অনেক কঠিন। আপনি জানবেন না, কোথায় রাস্তা ভেঙ্গে গর্ত হয়ে গেছে, পা টিপে টিপে আগাবেন, যেহেতু ইলেক্ট্রিসিটি নাই-সন্ধ্যার পর গোটা এলাকা অন্ধকার। মোবাইলের আলোই আপনার ভরসা। রাস্তা ভেঙ্গে, পিচ উঠে গিয়ে এক বাজে অবস্থা, আপনাকে খালি পায়ে হাটতে হবে, পা ছিলে যাবে, ব্যাথা করবে, এরপরেও আপনাকে ৫-৬ কিলোমিটার বা তার থেকে বেশি পানির উপর দিয়ে হেটে যেতে হবে।
আমি এমন ও দেখলাম, শুধু ১৮০ প্যাকেট নৌকা থেকে নেমে কাদামাটি পথ পার হয়ে আরেকটা নৌকায় তুলা লাগবে দেখে, একটা ত্রাণবাহী নৌকা পাড়ে নামে নাই। আবার এটাও দেখলাম, দায়সাড়া গোছের ভাবে নদীর পাড়ে মানুষদের ডেকে দিয়ে চলে গেছে। কিন্তু আমি এটাও দেখলাম, কত কষ্ট করে ছেলেরা পিছলে পথে মাথায় বা কাধে করে প্যাকেট নিয়ে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গাতে গেছে, কিভাবে না খেয়ে বা ব্যাথায় পেয়ে ও চুপ করে থেকে কাজ করে গেছে। আমি আরো দেখলাম কিভাবে কত হাসিমুখে মানুষের পাশে দাড়িয়েছে বা স্থানীয়ে মানুষজন আমাদের পাশে দাড়িয়েছে। আমাকে আন্দদিত করে যখন দেখি, ত্রাণ দিতে যাওয়া সবাই ভিন্ন ভিন্ন এলাকা থেকে আসলেও সবাই কিভাবে যেন ভাইবোন হয়ে এক পাল্লায় চলে আসে, কি সুন্দর দৃশ্য! ক্ষুধা, ক্লান্তি, শারিরীক কষ্ট তখন আর লাগে না।
কিছু অন্যরকম অভিজ্ঞতার কথা বলি,
কোথাও কোথাও নারীপুরুষরা নিজে থেকে কাজে সাহায্য করেছে। কিন্তু কষ্ট লেগেছে কিছু কিছু জায়গায় যখন তার বিনিময়ে টাকা চেয়েছে। আমি বলছিনা সবাই। এছাড়াও সত্যি বলতে এখনো কোথাও কোথাও নিজের লোকদের দেয়া বা ধর্মীয় ব্যাপারটা এখনো আমরা দেখেছি। এ ব্যাপারগুলা যেন ঝামেলায় রুপান্তরিত না হয়, সেদিকে খেয়াল করে ঠান্ডা মাথায় কাজ করে যেতে পারলে-সবাই সমান ভাবে সবকিছু পাবে।
আমার বাংলাদেশ আবার ঘুরে দাঁড়াবে, সবার একসাথে কাজের মধ্য দিয়ে আবার জেগে উঠবে। এর থেকে সুন্দর কিছু নাই। এর থেকে ভালো কিছু নাই।
-মোঃ আরিফ চৌধুরী
এক্সিকিউটিভ কোওর্ডিনেটর, এনভায়রনমেন্ট এন্ড ক্লাইমেট চেঞ্জ হাব।