30/04/2023
যোহরের সময়ে নামায নির্ধারণ হওয়ার কারণ
১ম উত্তর: যোহরের সময়কে নির্ধারণ করার কারণ হল মহাবিশ্বে সূর্য হল অনেক বড় একটা গ্রহ, এজন্য সূর্যপূজারী মুশরিকরা তার পূজা-অর্চনা করে। সূর্যোদয় থেকে তাদের পূজা শুরু হয়। দুপুর পর্যন্ত সূর্য ওপরে ওঠতে থাকে এবং সাথে সাথে তার ঔজ্জ্বল্য এবং তেজ বাড়তে থাকে। কিন্তু দুপুরের পর থেকে সূর্য ঢলতে শুরু করে, সাথে সাথে তার তেজ এবং গর্বও কমে যেতে থাকে। এই ঢলে যাওয়া তার নশ্বরতাকে প্রমাণ করে। যখন সূর্য ঢলে পড়ে, তখন যেন আল্লাহ বলেন, হে লোকসকল! ফজর থেকে দুপুর পর্যন্ত মুশরিকরা বাতিল উপাস্য অর্থাৎ সূর্যের পূজা করছিল। হে আমার বান্দা-বান্দিরা তোমরা কোথায়? আসো আমার ইবাদত কর। মুশরিকদের বিপরীতে যোহরের নামায আদায় কর। সূর্য পূজার জন্য তাদের ওপর গযব অবতীর্ণ হবে আর নামায পড়ার কারণে তোমাদের ওপর রহমত বর্ষিত হবে। তাই যোহরের সময় নামায নির্ধারণ করা হল।
২য় উত্তর: হযরত ইবরাহীম আ. যখন আগুনের গর্ত থেকে মুক্ত হয়েছিলেন, তখন সহজাত প্রবৃত্তির দাবি অনুযায়ী শৈশবেও আসল প্রভুর সন্ধান করার আগ্রহ অন্তরে ছিল। তাই রাতের আকাশে উজ্জ্বল তারা দেখে অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বলেছিলেন, এগুলো আমার প্রভু। যখন সেগুলো ডুবে গেল, তখন বলেছিলেন, যারা লুকিয়ে যায় তাদের আমি ভালবাসি না। তারপর যখন চন্দ্র উদিত হল, যার ঔজ্জ্বল্য তারাদের চেয়ে ঢের বেশি ছিল, তখন বললেন এটি আমার প্রভু। কিন্তু ফজরের সময় তার ঔজ্জ্বল্য গোপন হয়ে গেলে অনুতাপের সুরে বললেন, যদি আমার প্রভু আমায় সাহায্য না করেন, আমি তো নির্ঘাত পথহারা হয়ে যাব। ফজরের সময় যখন সূর্য উদিত হল, তখন অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে বললেন, ব্যস আমার প্রভু তো এটাই! এটা সবার বড়ও! কিন্তু যখন সূর্যও ঢলতে শুরু করল এবং তার আলো কমে যেতে লাগল, তখন বললেন, আমি শিরক থেকে মুক্ত। আমি নিজের চেহারা ঐ সত্ত্বার দিকে ফিরিয়ে নিলাম যিনি আসমান যমীন সৃষ্টি করেছেন। অতপর তিনি শুকরিয়া স্বরূপ যোহরের চার রাকাত নামায আদায় করেছিলেন। কুরআন কারীমে এর বর্ণনা এসেছে- যখন রজনীর অন্ধকার তার উপর সমাচ্ছন্ন হল, তখন সে একটি তারকা দেখতে পেল। বলল এটি আমার প্রতিপালক। তারপর যখন তা অস্তমিত হল, তখন বলল, আমি অস্তগামীদেরকে ভালবাসিনা। (সূরা আনয়াম, আয়াত: ৭৬)
আল্লাহ তায়ালা ইবরাহীম আ.-এর কথা ও নামায খুবই পছন্দ করলেন। যেভাবে তাঁর কুরবানী, পানির জন্য হাজেরা আ. এর দৌঁড়াদৌঁড়ি এবং তাওয়াফকে পছন্দ করলেন। এজন্যই সেই বিখ্যাত একত্ববাদী ব্যক্তি ইবরাহীম আ. এর স্মরণে সূর্য ঢলার পর যোহরের নামায ফরয করে দেয়া হয়েছে, যাতে যোহর আদায়কারীদের হাশর ইবরাহীম আ. এর সাথে হয়। কেননা, কেয়ামতের দিন তাঁর অনুসারীরাই তাঁর সাথে থাকবেন। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- মানুষদের ভেতর ইবরাহীমের সাথে (ঘনিষ্ঠবান) সম্পর্কেও বেশী অধিকার তো আছে সে সব লোকের, যারা তার অনুসরণ করেছে। (সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ৬৮)
৩য় উত্তর: হযরত আলী রা. বলেন, একদা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুহাজিরদের একটি জামাতে অবস্থানরত ছিলেন। এমন সময় ইহুদীদের একটা দল তাঁর দরবারে উপস্থিত হয়ে বলল, হে মুহাম্মদ! আমরা আপনাকে এমন কতিপয় প্রশ্ন করতে চাই, যার উত্তর উচু স্তরের পয়গম্বর ব্যতীত কারো পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ঠিক আছে প্রশ্ন করো।
ইহুদী দল: হে মুহাম্মদ! আপনার উম্মতের ওপর দিন-রাতে পাঁচ ওয়াক্ত নামায কেন ফরয হল এবং নির্দিষ্ট পাঁচটি সময়কে কেন নির্বাচিত করা হল?
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম : হে ইহুদীদল! যোহরের নামাযের ব্যাপারে হেকমত হল, তখন ফেরেশতারা আসমানের ওপর তাসবীহ পড়েন, সে সময় আসমানের দরজাসমূহ খুলে যায় এবং দোয়া কবুল হয়। এজন্য আল্লাহ তায়ালা সেই সময়ের নামায (যোহর) ফরয করে দিয়েছেন। যাতে ফেরেশতাকুলের সাথে মিলিত হয়, দোয়া কবুল এবং আমলসমূহ দ্রুত আসমানের ওপর পৌঁছে যায়। যে ব্যক্তি যোহরের নামায আদায় করবে, আল্লাহ তায়ালা জাহান্নামের আগুনের ওপর তার শরীরকে হারাম করে দিবেন। (মাজালেসে সুন্নিয়া)
নামাযের জন্য আসরের সময় কেন নির্ধারিত হল
১ম উত্তর: আসরের সময় হযরত আদম আ. স্ত্রীর কথা শুনে নিষিদ্ধ গাছের ফল ভক্ষণ করেছিলেন, যার ফলে তাঁকে দিগম্বর করে জান্নাত থেকে বের করে দিয়ে পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছিল। এসবকিছুই আসরের সময় ঘটেছিল। তিনি তখন নিষিদ্ধ গাছের ফল খেয়ে আল্লাহকে নারাজ করেছিলেন। এর বিপরীতে উম্মতে মুহাম্মদীকেও সর্বপ্রকার খানা-পিনা থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে, আর অল্প সময়ের জন্য নামাযে মশগুল হয়ে রোযাদারের মত থাকতে বলা হয়েছে। যাতে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করে রহমত আর নেয়ামতের যোগ্য হয়ে যায়। আদম আ. আসরের সময় আল্লাহর মর্জির খেলাফ কাজ করেছিল। নিষিদ্ধ ফল খেয়ে জান্নাত থেকে বের হয়ে পৃথিবী নামক কয়েদ খানায় আসতে হয়েছিল, একই সময়ে এই উম্মত, খানাপিনা ত্যাগ করে, অন্যের সাথে কথাবার্তা না বলে আল্লাহর কথা মেনে নামায পড়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করবে।
২য় উত্তর: হযরত ইউনুস আ. কে আল্লাহ চার ধরনের অন্ধকারে বন্দী করেছিলেন, ১. সমুদ্রের অন্ধকারে, ২. মৎস উদরের অন্ধকারে, ৩. আবার উক্ত মৎসকে যে বড় মৎস গিলেছিল তার অন্ধকারে, ৪. রাতের অন্ধকারে।
হযরত ইউনুস আ. প্রচুর অন্ধকারে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে মাছের পেটের ভিতর দোয়া ইউনুস পাঠ করা শুরু করে দিলেন। এটি পড়ার দরুন মাছ তাঁকে জমির ওপর বের করে দিতে আদিষ্ট হল। কুরআন বলছে- যদি তিনি তাসবীহ না পড়তেন, কেয়ামত পর্যন্ত মৎস উদরেই থেকে যেতেন। তাই মাছ তাঁকে স্থলভাগে এসে উগরে দিল। (তাফসীর, সূরা সাফফাত, আয়াত ১৪৩ ও ১৪৪)
আসরের সময় তিনি চার ধরনের অন্ধকার থেকে মুক্তি পাওয়ার ওপর শুকরিয়া স্বরূপ চার রাকাত নামায পড়েছিলেন, এজন্য আল্লাহ তাআলা আমাদের ওপর এই সময়ে চার রাকাত নামায ফরয করে দিয়েছেন। যাতে ইউনুস আ. এর বিপদের কথা স্মরণ থাকে ও আল্লাহর নাম এবং তাঁর তাসবীহ’র শক্তিমত্তার কথা খেয়াল থাকে। আর নামাযের বরকতে ইউনুস আ. এর মত সর্বপ্রকার বিপদ-আপদ থেকে মুক্ত থাকা যায়।
৩য় উত্তর: প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য মৃত্যুর পর কবরের প্রশ্ন আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত আছে। আর মৃত ব্যক্তির জন্য সময়টি অত্যন্ত কঠিন হবে এবং খুবই অপারগ বিষয় হবে। কিন্তু আল্লাহ স্বীয় বান্দাদের জন্য আসরের নামায ফরয করার মাধ্যমে সেই কঠিনতম অবস্থাকে সহজ করে দিয়েছেন। এভাবে যে, যখন মৃত ব্যক্তিকে দ্বিতীয়বার জীবিত করা হবে, তখন তার মনে হবে, এই বুঝি আসরের সময় চলে যাচ্ছে, এখনই সূর্য ডুবে যাবে। আবার এদিকে মুনকার-নাকির খুব দ্রুত এবং ভয়ঙ্কর আকৃতি ধারণ করে প্রশ্ন করবেন, তোমার প্রভু কে? আর নামাযী ব্যক্তি নামাযের চিন্তায় এতই মগ্ন থাকবেন যে, তিনি প্রশ্নের কোন পরওয়াই করবেন না। কোন ধরণের ভয়ভীতিও তার থাকবে না। তাই আল্লাহ তায়ালা আসরের নামায ফরয করেছেন, যাতে সেই সময় মুসলমান নামাযের অভ্যস্ত থাকে। আর কবরের প্রশ্নের সময় শুধু নামাযের কথাই অন্তরে থাকে। আর তার অন্তর যেন নামাযের দিকেই ফিরানো থাকে। মুনকার-নাকিরের আওয়াজের প্রতি ভ্রুক্ষেপও যেন তার না থাকে বরং সে যেন নামায নামায বলে শ্লোগান দিতে থাকে। আর এটা কোন নতুন বিষয় নয়। এ ধরণের শত শত ঘটনা ইতিপূর্বে সংঘটিত হয়েছে, এখনো হচ্ছে, কোন প্রিয় বস্তুর চিন্তায় পড়লে অন্য সবকিছু থেকে বে-খবর হয়ে যায়।