ASK MUFTI SAHEB

ASK MUFTI SAHEB

As salamualikum .This is ASK M***I SAHEB And wel come my page.Here you will find a lot videos rele

10/04/2022

A.প্রত্যেক সুস্থ মস্তিষ্ক বালেগ মুসলিমের উপর রমযানের রোযা ফরয। (সূরা বাকারা : ১৮৫; রদ্দুল মুহতার ২/৩৭২)
শাবানের ২৯ তারিখ দিবাগত সন্ধ্যায় চাঁদ দেখা প্রমাণিত হলে পরদিন থেকে রোযা রাখতে হবে। নতুবা শাবানের ৩০ দিন পূর্ণ করার পর রোযা রাখা শুরু করবে। (সহীহ মুসলিম ১/৩৪৭)
B.আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকলে রোযা শুরুর জন্য এমন একজন ব্যক্তির চাঁদ দেখাই যথেষ্ট হবে, যার দ্বীনদার হওয়া প্রমাণিত কিংবা অন্তত বাহ্যিকভাবে দ্বীনদার। (মুসতাদরাকে হাকিম ১/৪২৪; রদ্দুল মুহতার ২/৩৮৫)
C.আকাশ পরিষ্কার থাকলে একজনের খবর যথেষ্ট নয়; বরং এত লোকের খবর প্রয়োজন, যার দ্বারা প্রবল বিশ্বাস জন্মে যে, চাঁদ দেখা গেছে। কেননা, যে বিষয়ে অনেকের আগ্রহ ও সংশ্লিষ্টতা থাকে তাতে দু’ একজনের খবরের উপর নির্ভর করা যায় না। (রদ্দুল মুহতার ৩/৩৮৮)
D.কোনো ব্যক্তি একাকী চাঁদ দেখেছে, কিন্তু তার সাক্ষ্য গৃহিত হয়নি, এক্ষেত্রে তার জন্য ব্যক্তিগতভাবে রোযা রাখা উত্তম, জরুরি নয়। এমন ব্যক্তির জন্য রোযা রাখা জরুরি না হলেও উত্তম হল রোযা রাখা। (মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক ৪/১৬৮; বাদায়েউস সানায়ে ২/২২১)
E.শাবান মাসের ২৯ ও ৩০ তারিখে রোযা রাখবে না; না রমযানের নিয়তে না নফলের নিয়তে। অবশ্য যে পূর্ব থেকেই কোনো নির্দিষ্ট দিবসে (যেমন, সোম ও মঙ্গলবার) নফল রোযা রেখে F.আসছে, আর ঘটনাক্রমে শাবানের ২৯ ও ৩০ তারিখে ঐ দিন পড়েছে তার জন্য এই তারিখেও নফল রোযা রাখা জায়েয। (সহীহ বুখারী হাদীস: ১৯১; বাদায়েউস সানায়ে ২/২১৭)
G.রোযার নিয়ত করা ফরয। নিয়ত অর্থ সংকল্প। যেমন মনে মনে এ সংকল্প করবে, আমি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে আগামী কালের রোযা রাখছি। মুখে বলা জরুরি নয়। (সহীহ বুখারী ১/২; বাদায়েউস সানায়ে ২/২২৬)
H.ফরয রোযার নিয়ত রাতেই করা উত্তম। (সুনানে আবু দাউদ ১/৩৩৩; বাদায়েউস সানায়ে ২/২২৯)
রাতে নিয়ত করতে না পারলে দিনে সূর্য ঢলার প্রায় এক ঘণ্টা আগে নিয়ত করলেও রোযা হয়ে যাবে। (সহীহ বুখারী ২০০৭; বাদায়েউস সানায়ে ২/২২৯)
I.পুরো রমযানের জন্য একত্রে নিয়ত করা যথেষ্ট নয়; বরং প্রত্যেক রোযার নিয়ত পৃথক পৃথকভাবে করতে হবে। কারণ প্রতিটি রোযা ভিন্ন ভিন্ন আমল (ইবাদত)। আর প্রতিটি আমলের জন্যই নিয়ত করা জরুরি। (সহীহ বুখারী ১/২; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/১৯৫)
J.রাতে রোযার নিয়ত করলেও সুবহে সাদিক পর্যন্ত পানাহার ও স্ত্রী-মিলনের অবকাশ থাকে। এতে নিয়তের কোনো ক্ষতি হবে না। (সূরা বাকারা : ১৮৭)
K.নিয়তের সময় শুরু হয় পূর্বের দিনের সূর্যাস্তের পর থেকে। যেমন-মঙ্গলবারের রোযার নিয়ত সোমবার দিবাগত রাত তথা সূর্যাস্তের পর থেকে করা যায়। সোমবার সূর্যাস্তের পূর্বে মঙ্গলবারের রোযার নিয়ত করা যথেষ্ট নয়। কেননা, হাদীস শরীফে রাতে নিয়ত করার কথা বলা হয়েছে। (আলমুহীতুল বুরহানী ৩/৩৪৩; রদ্দুলমুহতার ২/৩৭৭)
L.রমজানের সাহরী বিষয়ক মাসআলা সমূহ
মাসআলা: সাহরী খাওয়া সুন্নত। পেট ভরে খাওয়া জরুরি নয়, এক ঢোক পানি পান করলেও সাহরীর সুন্নত আদায় হবে। (সহীহ মুসলিম ১/৩৫০)
সুবহে সাদিকের কাছাকাছি সময় সাহরী খাওয়া মুস্তাহাব। তবে এত দেরি করা মাকরূহ যে, সুবহে সাদিক হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা হয়। (আলমুজামুল আওসাত ২/৫২৬)
M.দেরি না করে সূর্যাস্তের সাথে সাথে ইফতার করা মুস্তাহাব।-সহীহ বুখারী ১/২৬৩
N.মাগরিবের নামায পড়ার আগেই ইফতার করে নিবে, যেন সূর্যাস্তের সাথে সাথে ইফতার করার সওয়াব পাওয়া যায়। (সুনানে তিরমিযী, হাদীস : ৬৯২)
O.খেজুর দ্বারা ইফতার করা মুস্তাহাব। খেজুর না পেলে পানি দ্বারা ইফতার করবে। (সুনানে তিরমিযী, হাদীস : ৬৯৪)
P.রমযানে রোযা রেখে দিনে স্ত্রী সহবাস করলে বীর্যপাত না হলেও স্বামী-স্ত্রী উভয়ের উপর কাযা ও কাফফারা ওয়াজিব হবে। (সহীহ বুখারী ৬৭০৯)
Q.রোযা রেখে স্বাভাবিক অবস্থায় ইচ্ছাকৃতভাবে পানাহার করলে কাযা ও কাফফারা উভয়টি জরুরি হবে। (সুনানে দারাকুতনী ২/১৯১; আলবাহরুর রায়েক ২/২৭৬)
R.বিড়ি-সিগারেট, হুক্কা পান করলেও রোযা ভেঙ্গে যাবে এবং কাযা ও কাফফারা উভয়টি জরুরি হবে। (রদ্দুল মুহতার ৩/৩৮৫)
S.সুবহে সাদিক হয়ে গেছে জানা সত্ত্বেও আযান শোনা যায়নি বা এখনো ভালোভাবে আলো ছাড়ায়নি এ ধরনের ভিত্তিহীন অজুহাতে খানাপিনা করলে বা স্ত্রী সহবাসে লিপ্ত হলে কাযা-কাফফারা দু’টোই জরুরি হবে। (সূরা বাকারা : ১৮৭; মাআরিফুল কুরআন ১/৪৫৪-৪৫৫)
রমজানের কাফফারা আদায় বিষয়ক মাসয়ালা-মাসায়েল
T.একটি রোযার জন্য দুই মাস ধারাবাহিকভাবে রোযা রাখতে হবে। কোনো কারণে ধারাবাহিকতা ছুটে গেলে পুনরায় নতুন করে রোযা রাখতে হবে। পেছনের রোযাগুলো কাফফারার রোযা হিসাবে ধর্তব্য হবে না। তবে মহিলাদের হায়েযের কারণে ধারাবাহিকতা নষ্ট হলে অসুবিধা নেই। (আলমুহাল্লা ৪/৩৩১; আলবাহরুর রায়েক ২/২৭৭)
U.যেসব কারণে রোযা ভেঙ্গে যায় এবং শুধু কাযা করতে হয় সেই বিষয়ক মাসয়ালা-মাসায়েল
অযু বা গোসলের সময় রোযার কথা স্মরণ থাকা অবস্থায় অনিচ্ছাকৃতভাবে গলার ভেতর পানি চলে গেলে রোযা ভেঙ্গে যাবে। তাই রোযা অবস্থায় অযু-গোসলের সময় নাকের নরম স্থানে পানি পৌঁছানো এবং গড়গড়াসহ কুলি করবে না। (সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ২৩৬৩; ফাতাওয়া শামী ২/৪০১)
V.যা সাধারণত আহারযোগ্য নয় বা কোনো উপকারে আসে না, তা খেলেও রোযা ভেঙ্গে যাবে এবং কাযা করতে হবে। (সহীহ বুখারী ১/২৬০ (তা’লীক); রদ্দুল মুহতার ২/৪১০)
দাঁত থেকে রক্ত বের হয়ে যদি তা থুথুর সাথে ভেতরে চলে যায় তবে রক্তের পরিমাণ থুথুর সমান বা বেশি হলে রোযা ভেঙ্গে যাবে। (রদ্দুল মুহতার ২/৩৯৬)
W.হস্তমৈথুনে বীর্যপাত হলে রোযা ভেঙ্গে যাবে। আর এটা যে ভয়াবহ গুনাহের কাজ তা বলাই বাহুল্য। (সহীহ বুখারী ১/২৫৪; ফাতাওয়া শামী ২/৩৯৯)
X.মুখে বমি চলে আসার পর ইচ্ছাকৃতভাবে গিলে ফেললে রোযা ভেঙ্গে যাবে। যদিও তা পরিমাণে অল্প হয়। (আদ্দুররুল মুখতার ২/৪১৫)
রোযা অবস্থায় হায়েয বা নেফাস শুরু হলে রোযা ভেঙ্গে যাবে। পরে তা কাযা করতে হবে। (সহীহ বুখারী ১/৪৪; আননুতাফ ফিল ফাতাওয়া ১০০)
পেটের এমন ক্ষতে ওষুধ লাগালে রোযা ভেঙ্গে যাবে, যা দিয়ে ওষুধ পেটের ভেতর চলে যায়। বিশেষ প্রয়োজনে এমন ক্ষতে ওষুধ লাগাতে হলে পরে সে রোযার কাযা করে নিতে হবে। (রদ্দুল মুহতার ২/৪০২)
Y.নাকে ওষুধ বা পানি দিলে তা যদি গলার ভেতরে চলে যায় তাহলে রোযা ভেঙ্গে যাবে এবং কাযা করতে হবে।
মলদ্বারের ভেতর ওষুধ বা পানি ইত্যাদি গেলে রোযা ভেঙ্গে যাবে। (রদ্দুল মুহতার ২/৪০২)
সুবহে সাদিকের পর সাহরীর সময় আছে ভেবে পানাহার বা স্ত্রীসঙ্গম করলে রোযা ভেঙ্গে যাবে। তেমনি ইফতারির সময় হয়ে গেছে ভেবে সূর্যাস্তের পূর্বে ইফতার করে নিলে রোযা নষ্ট হয়ে যাবে। (আলবাহরুর রায়েক ২/২৯১)
রোযা রাখা অবস্থায় ভুলবশত পানাহার করে রোযা নষ্ট হয়ে গেছে ভেবে ইচ্ছাকৃতভাবে পানাহার করলে রোযা নষ্ট হয়ে যাবে এবং কাযা করা জরুরি হবে।
অনিচ্ছাকৃত বমি হওয়ার কারণে রোযা নষ্ট হয়ে গেছে মনে করে রোযা ভেঙ্গে ফেললে কাযা করতে হবে। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ৬/১৪৯; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ৬/১৫০; আদ্দুররুল মুখতার ২/৪০১)
যেসব কারণে রোযা ভাঙে না সেই বিষয়ক মাসয়ালা-মাসায়েল
কোনো রোযাদার রোযার কথা ভুলে গিয়ে পানাহার করলে তার রোযা নষ্ট হবে না। তবে রোযা স্মরণ হওয়া মাত্রই পানাহার ছেড়ে দিতে হবে। (সহীহ মুসলিম ১/২০২; আলবাহরুর রায়েক২/২৭১)
চোখে ওষুধ-সুরমা ইত্যাদি লাগালে রোযার কোনো ক্ষতি হয় না। (সুনানে আবু দাউদ ১/৩২৩; রদ্দুল মুহতার ২/৩৯৫)
রাত্রে স্ত্রীসহবাস করলে বা স্বপ্নদোষ হলে সুবহে সাদিকের আগে গোসল করতে না পারলেও রোযার কোনো ক্ষতি হবে না। তবে কোনো ওযর ছাড়া, বিশেষত রোযার হালতে দীর্ঘ সময় অপবিত্র থাকা অনুচিত।
বীর্যপাত ঘটা বা সহবাসে লিপ্ত হওয়ার আশঙ্কা না থাকলে স্ত্রীকে চুমু খাওয়া জায়েয। তবে কামভাবের সাথে চুমু খাওয়া যাবে না। আর যুবকদের যেহেতু এমন আশঙ্কা থাকে তাই তাদের বেঁচে থাকা উচিত। (মুসনাদে আহমদ ২/১৮০, ২৫০; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/২০০)
অনিচ্ছাকৃত বমি হলে (মুখ ভরে হলেও) রোযা ভাঙ্গবে না। তেমনি বমি মুখে এসে নিজে নিজে ভেতরে চলে গেলেও রোযা ভাঙ্গবে না। (জামে তিরমিযী হাদীস: ৭২০; রদ্দুল মুহতার ২/৪১৪)
শরীর বা মাথায় তেল ব্যবহার করলে রোযা ভাঙ্গবে না। (মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক ৪/৩১৩; আলবাহরুর রায়েক ২/১৭)
Z.শুধু যৌন চিন্তার কারণে বীর্যপাত হলে রোযা ভাঙ্গবে না। তবে এ কথা বলাই বাহুল্য যে, সব ধরনের কুচিন্তা তো এমনিতেই গুনাহ আর রোযার হালতে তো তা আরো বড় অপরাধ। (রদ্দুল মুহতার ২/৩৯৬)

10/04/2022

রহমত বরকত ও মাগফেরাতের মাস রমযান। এই মাস তাই সবার কাছেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সবাই চায় কীভাবে এ মাস থেকে বেশি বেশি উপকৃত হওয়া যায়। সবাই আন্তরিকভাবে কামনা করে নিজেকে সকল প্রকার পাপ-পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত করে পবিত্র একটি জীবন শুরু করতে।

হিজরী পঞ্জিকার বারোটি মাসের মধ্যে শুধুমাত্র একটি মাসের নামই পবিত্র কোরআনে উল্লেখ করা হয়েছে আর সে মাসটি হলো রমযান। যা এ মাসটির অসামান্য মর্যাদা পরিচয় বহন করে।

রমযান একটি আরবি শব্দ। এর শব্দমূল হলো রা-মিম-দোয়াদ । আরবি ভাষায় এর অর্থ হচ্ছে অতিরিক্ত গরম,কঠোর সূর্যতাপ,দহন,জ্বলন,তৃষ্ণা এবং গলে যাওয়া। রমযান মাসে যেহেতু নেক আমলের কারণে বিগত গুনাহ বা পাপগুলো বিমোচিত হয়ে যায় কিংবা গলে গলে নিঃশেষ হয়ে যায় সেজন্যেই এ মাসের নাম হলো রমযান।

ইসলামের মৌলিক পাঁচটি বিধানের একটি হলো রোযা। তবে এই বিধানটি কেবল আমাদের জন্যেই নয় বরং আমাদের পূর্ববর্তী নবী রাসূলগণের উম্মাতদের জন্যেও অবশ্য পালনীয় কর্তব্য হিসেবে বিধিবদ্ধ করা হয়েছিল। মহান রাব্বুল আলামীন পবিত্র কোরআনে বলেছেন,

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِن قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ

অর্থাৎ “হে বিশ্বাসিগণ! রোযা যেরূপ তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর আবশ্যিক ছিল তেমনি তোমাদের ওপরও তা আবশ্যিক করা হল;হয়ত তোমরা সাবধানী (ও আত্মসংযমী) হবে।” (সূরা বাকারাহ-১৮৩)

একই সূরায় তিনি আরও বলেছেন :

شَهْرُ‌ رَ‌مَضَانَ الَّذِي أُنزِلَ فِيهِ الْقُرْ‌آنُ هُدًى لِّلنَّاسِ وَبَيِّنَاتٍ مِّنَ الْهُدَىٰ وَالْفُرْ‌قَانِ فَمَن شَهِدَ مِنكُمُ الشَّهْرَ‌ فَلْيَصُمْهُ

“রমযান মাস,যাতে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে,যা মানবজাতির জন্য দিশারী এবং এতে পথনির্দেশ ও সত্য ও মিথ্যার পার্থক্যকারী সুস্পষ্ট নিদর্শন রয়েছে। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে কেউ এ মাসে (স্বস্থানে) উপস্থিত থাকবে সে যেন রোযা রাখে”। (সূরা বাকারাহ-১৮৫)

রোযার গুরুত্ব সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেছেন:“রোযা একান্তই আমার জন্য আর আমিই এর প্রতিদান দেবো।”

পরকালে যে তিনি কী পুরস্কার দেবেন তার কিছুটা ইঙ্গিত নবী কারিম (সা.) আমাদের দিয়েছেন। সে থেকে রোযাদারগণ নিশ্চয়ই পরিতৃপ্ত হবার আনন্দ পাবেন। রাসূলে খোদা বলেছেন,‘রমযান এমন একটি মাস যে মাসে আল্লাহ তোমাদের জন্যে রোযা রাখাকে ফরজ করে দিয়েছে। অতএব যে ব্যক্তি ঈমান সহকারে আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশায় রোযা রাখবে,তার জন্যে রোযার সেই দিনটি হবে এমন যেন সবেমাত্র সে মায়ের গর্ভ থেকে জন্ম নিয়েছে,অর্থাৎ রোযাদার তার সকল গুণাহ থেকে মুক্তি পেয়ে নিষ্পাপ শিশুটির মতো হয়ে যাবে।

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) পবিত্র রমজানের ফজিলত,গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন,পবিত্র রমজান মাস দয়া,কল্যাণ ও ক্ষমার মাস ৷ এ মাস মহান আল্লাহর কাছে শ্রেষ্ঠ মাস ৷ এ মাসের দিনগুলো সবচেয়ে সেরা দিন,এর রাতগুলো শ্রেষ্ঠ রাত এবং এর প্রতিটি মুহূর্ত অত্যন্ত মূল্যবান ৷রহমত বরকত ও মাগফিরাতের মাস তথা পবিত্র রমজান মাসে আল্লাহর দস্তরখান আমাদের জন্যে উন্মুক্ত ৷ তিনি তোমাদেরকে এ মাসে সম্মানিত করেছেন। এ মাসে তোমাদের প্রতিটি নিঃশ্বাস মহান আল্লাহর গুণগান বা জিকিরের সমতুল্য;এ মাসে তোমাদের ঘুম প্রার্থনার সমতুল্য,এ মাসে তোমাদের সৎকাজ এবং প্রার্থনা বা দোয়াগুলো কবুল করা হবে ৷ তাই মহান আল্লাহর কাছে আন্তরিক ও পবিত্র চিত্তে প্রার্থনা করো যে,তিনি যেন তোমাদেরকে রোজা রাখার এবং কোরআন তেলাওয়াতের তৌফিক দান করেন ৷গুনাহর জন্যে অনুতপ্ত হও ও তওবা কর এবং নামাজের সময় মোনাজাতের জন্যে হাত উপরে তোলো,কারণ নামাজের সময় দোয়া কবুলের শ্রেষ্ঠ সময়,এ সময় মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাদের দিকে রহমতের দৃষ্টিতে তাকান,এ সময় কেউ তাঁর কাছে কিছু চাইলে তিনি তা দান করেন,কেউ তাঁকে ডাকলে তিনি জবাব দেন,কেউ কাকুতি-মিনতি করলে তার কাকুতি মিনতি তিনি গ্রহণ করেন ৷কেননা পবিত্র কোরআনে সুরা গাফিরের ৫৯ নম্বর আয়াতে তিনি নিজেই বলেছেন,

ادْعُونِي أَسْتَجِبْ لَكُمْ إِنَّ الَّذِينَ يَسْتَكْبِرُ‌ونَ عَنْ عِبَادَتِي سَيَدْخُلُونَ جَهَنَّمَ دَاخِرِ‌ينَ

তোমরা আমাকে ডাক,আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেবো,নিশ্চয় যারা আমার আমার ইবাদত হতে বিমুখ,তারা লাঞ্চিত হয়ে জাহান্নামে প্রবেশ করবে৷"

মানবতার মুক্তির দূত বিশ্বনবী (সা.) রমজানের গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য সম্পর্কে আরো বলেছেন,হে মানব সকল ! তোমরা তোমাদের আত্মাকে নিজ কামনা-বাসনার দাসে পরিণত করেছো,আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে একে মুক্ত করো ৷ তোমাদের পিঠ গোনাহর ভারে ভারাক্রান্ত হয়ে আছে,তাই সেজদাগুলোকে দীর্ঘায়িত করে পিঠকে হালকা করো ৷ জেনে রাখ মহান আল্লাহ নিজ সম্মানের শপথ করে বলেছেন,রমজান মাসে নামাজ আদায়কারী ও সেজদাকারীদেরকে শাস্তি বা আজাব দিবেন না এবং কিয়ামতের দিন তাদেরকে দোযখের আগুন থেকে রক্ষা করবেন ৷ হে আল্লাহর বান্দারা ! তোমাদের যে কেউ কোনো মুমিনকে ইফতারিদেবে,আল্লাহ তাঁকে এর বিনিময়ে একজন দাসকে মুক্ত করার সওয়াব দান করবেন এবং দয়াময় আল্লাহ তাঁর অতীতের গুনাহও ক্ষমা করে দেবেন ৷"

সাহাবীরা আরজ করলেন,অন্যদেরকে ইফতারি করানোর সামর্থ আমাদের সবার নেই৷" তিনি বললেন,রোজাদারদের ইফতারি দেয়ার মাধ্যমে জাহান্নামের আগুন থেকে নিজেকে দূরে রাখ,আর সে ইফতারি যদি একটি খুরমার অর্ধেক বা এমনকি সামান্য পানিও হয়ে থাকে ৷"

তিনি (সা.) আরো বলেছেন,জান্নাতের মধ্যে আটটি দরজা আছে।এর মধ্যে একটি দরজার নাম রাইয়ান৷ এ দরজা দিয়ে কেবল রোযাদার ব্যক্তিরাই প্রবেশ করতে পারবে৷ সেদিন এই বলে ডাক দেয়া হবে- রোযাদার কোথায় ? তারা যেন এই পথে বেহেশতে প্রবেশ করে। এভাবে সকল রোযাদার ভিতরে প্রবেশ করার পর দরজাটি বন্ধ করে দেয়া হবে৷ রাসূলে খোদা আরো বলেছেন,রোযাদারের মুখের গন্ধ আল্লাহ তায়ালার কাছে মেশক হতেও পবিত্র ও সুগন্ধিময়। সুতরাং রোযা অবস্থায় কেউ যেন অশ্লীলতায় লিপ্ত না হয় এবং ঝগড়া বিবাদ না করে।

নিঃসন্দেহে সে ব্যক্তি প্রকৃতই দূর্ভাগা বা হতভাগ্য যে রমজান মাস পেয়েও মহান আল্লাহর ক্ষমা হতে বঞ্চিত হয়।বিশ্বনবী রাহমাতুল্লিল আলামীন আরো বলেছেন,রমজান মাসে ক্ষুধা ও তৃষ্ণার মাধ্যমে কিয়ামত বা শেষ বিচার দিবসের ক্ষুধা ও তৃষ্ণার কথা স্মরণ কর ।অভাবগ্রস্ত ও দরিদ্রদেরকে সাহায্য কর ও সাদাকা দাও।বয়স্ক ও বৃদ্ধদেরকে সম্মান কর এবং শিশু ও ছোটদেরকে স্নেহ কর৷ আত্মীয় স্বজনের সাথে সম্পর্ক ও যোগাযোগ রক্ষা কর । তোমাদের জিহবাকে সংযত রাখ,নিষিদ্ধ বা হারাম দৃশ্য দেখা থেকে চোখকে আবৃত রাখ,যেসব কথা শোনা ঠিক নয় সেসব শোনা থেকে কানকে নিবৃত রাখ ৷ এতিমদেরকে দয়া কর যাতে তোমার সন্তানরা যদি এতিম হয় তাহলে তারাও যেন দয়া পায় ৷

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) আরো বলেছেন,যারা এই মাসে অর্থাৎ পবিত্র রমজান মাসে নিজ ব্যবহার ও আচার আচরণকে সুন্দর করবে তারা সেদিন সহজেই পুলসিরাত পার হয়ে যাবে। যারা এই মাসে ভৃত্য বা অধীনস্তদের কাজ কমিয়ে দেবে মহান আল্লাহ শেষ বিচার দিবসে তার হিসাব সহজ করে দেবেন ৷ যারা এই মাসে অর্থাৎ রমজান মাসে মানুষকে বিরক্ত করা বা কষ্ট দেয়া থেকে বিরত থাকবে,বা অন্যদের দোষ ঢেকে রাখবে,কিয়ামতের দিন মহান আল্লাহ নিজ ক্রোধ থেকে তাদের রক্ষা করবেন ৷ যারা রমজান মাসে এতীমকে আদর যত্ন বা সম্মান করবে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাদেরকে সম্মান করবেন ৷ যারা এই মাসে আত্মীয়-স্বজনের সাথে ভালো ব্যবহার করবে ও তাদের সাথে সম্পর্ক রাখবে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাদেরকে রহমতের ধারায় সিক্ত করবেন,আর যারা এই মাসে আত্মীয় স্বজনের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করবে বা তাদের সাথে খারাপ ব্যবহার করবে আল্লাহ শেষ বিচার দিবসে তাদেরকে নিজ রহমত থেকে বঞ্চিত করবেন ৷"

মানবজাতির সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষক বিশ্বনবী (সা.) পবিত্র রমজানের ফজিলত সম্পর্কে আরো বলেছেন,যে এই মাসে নফল নামাজ আদায় করবে আল্লাহ তাকে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি দেবেন,যে একটি ফরজ নামাজ আদায় করবে তাকে অন্য মাসের সত্তুরটি ওয়াজিব নামাজ আদায়ের সওয়াব দান করবেন ৷ যে কেউ এ মাসে আমার প্রতি বার বার দরুদ পাঠাবে আল্লাহ তার সৎ আমলের পাল্লা ভারী করে দেবেন ৷ আর যে ব্যক্তি এই মাসে অর্থাৎ রমজান মাসে পবিত্র কোরআনের একটি আয়াত তেলাওয়াত করবে সে ব্যক্তি অন্য মাসে সমগ্র কোরআন তেলাওয়াতের সমান পরিমাণ সওয়াব পাবে ৷

হে আল্লাহর প্রিয় বান্দারা ! এই মাসে বেহেশতের দরজাগুলো খুলে দেয়া হয়েছে,আল্লাহর কাছে প্রার্থনা কর যেন এ দরজাগুলো তোমাদের জন্যে বন্ধ হয়ে না যায়। এই মাসে জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করা হয়েছে,তাই আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করো যেন এই দরজাগুলো কখনও তোমাদের জন্যে খুলে দেয়া না হয়৷ শয়তানগুলোকে এ মাসে হাতে পায়ে শিকল পরিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে,আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করো সেগুলো যেন তোমাদের ওপর কর্তৃত্ব করতে না পারে।

রমজান মাস সম্পর্কে নবী করিম (সা.)এর এই ভাষণের এক পর্যায়ে আমিরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.) বললেন,হে আল্লাহর রাসূল! এ মাসের শ্রেষ্ঠ আমল কি?

রাসূল (সা.) বললেন,হে আবুল হাসান! এ মাসের শ্রেষ্ঠ কাজ বা আমল হলো নিষিদ্ধ কাজগুলো থেকে বিরত থাকা।

14/11/2020

👉চুল দাড়িতে কলপ ব্যবহার করা কি জায়েজ?
***চুল-দাড়িতে কলপ, খেজাব বা মেহেদি অনেকেই ব্যবহার করে থাকেন। বার্ধক্য মানবজীবনের এক অনিবার্য বাস্তবতা। বেঁচে থাকলে প্রত্যেকটি মানুষ বৃদ্ধ হবেন এটাই আল্লাহর বিধান। বার্ধক্য এলে অনেকের চুল-দাড়ি ধবধবে সাদা হয়ে যায়। সাদা দাড়িওয়ালা অনেকে দাড়ি ও চুলে খেজাব বা মেহেদি ব্যবহার করেন। আবার বার্ধক্যজনিত কারণ ছাড়াও অপরিণত বয়ইে অনেক যুবকের মাথার চুল পেকে যায়। চুল কালো করতে তারাও বিভিন্ন পদ্ধতির আশ্রয় নেন। চুল-দাড়িতে কলপ, খেজাব বা মেহেদি যাই হোক, তা ব্যবহারের আগে মুসলমানদের উচিত ইসলামের দৃষ্টিতে তা কতটা বৈধ তা জেনে নেওয়া।

বার্ধক্যজনিত কারণে কারো চুল-দাড়ি পেকে গেলে তাতে খেজাব ব্যবহার করা বৈধ। তবে তা কালো খেজাব হতে পারবে না। নবীজি ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মূলত মেহেদি বা এ ধরণের রঙের কোনো জিনিস দ্বারা চুল-দাড়ি রাঙাতে উৎসাহ দিয়েছেন।
হজরত জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, মক্কা বিজয়ের দিনে আবু কুহাফাকে আনা হলো। তখন তার চুল-দাড়ি ছিল ‘ষাগামা’ ফুলের মতো সাদা। তখন রাসুল (সা.) বললেন, ‘এটিকে কোনো কিছু দ্বারা পরিবর্তন করো। তবে কালো থেকে বিরত থাকো।’ (সহিহ মুসলিম : ৫৪৬৬, মিশকাত ৪৪২৪ নং)

এ হাদিসে কালো ছাড়া মেহেদি রঙ বা অন্য খেজাব ব্যবহারের উৎসাহ দেয়া হয়েছে এবং কালো খেজাব ব্যবহার করতে নিষেধ করা হয়েছে।

আর সবার উদ্দেশ্যে সাধারণ নির্দেশ দিয়ে আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেন, শেষ যুগে এমন এক শ্রেণির লোক হবে, যার পায়রার ছাতির মতো কালো কলপ ব্যবহার করবে, তারা জান্নাতের সুগন্ধও পাবে না। (আবু দাউদ ৪২১২, নাসাই, সহিহুল জামে ৮১৫৩ নং)

হজরত আবু উমামা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুল (সা.) কিছু আনসার সাহাবাদের উদ্দেশে বলেন, সাদা দাঁড়ি চুলগুলো লাল অথবা হলুদ রঙ দ্বারা পরিবর্তন করো এবং আহলে কিতাবদের বিরোধিতা করো। (আহমাদ ২২৩৩৭)

এসব হাদিস থেকে বোঝা যায় যে, চুল বা দাঁড়িতে কালো রঙ করা যাবে না। তবে অন্য যে কোনো রঙ করা যাবে। অর্থাৎ কালো বাদে অন্য যে কোনো রঙ করা যাবে এবং সেটি নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যই প্রযোজ্য। কেননা নারীদেরও তো চুল সাদা হতে পারে।
হজরত উসমান ইবনে মাওহাব রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, একদিন হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহুকে জিজ্ঞাসা করা হলো যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কি খেজাব ব্যবহার করতেন? তখন তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ’। (তাহজিবুল আছার)

**হজরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সঃ) এর মাথার চুল খিযাবকৃত দেখেছি।’

সুন্নাতের অনুসরণ ও অনুকরণে হজরত ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন একনিষ্ঠ। তিনি প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাতের অনুসরণ ও অনুকরণের সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতেন। এমনকি চুল ও দাঁড়িতে খেজাব দেয়ার ক্ষেত্রেও প্রিয়নবির অনুসরণ ও অনুকরণ করেছেন এভাবে-

- হজরত যাইদ ইবনু আসলাম বলেন, আমি ইবনু ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুকে দেখলাম যাফরান মিশ্রিত সুগন্ধ ‘খালুক’ খেজাব দ্বারা তাঁর দাঁড়ি হলুদ রঙে খেজাব করেছেন। তাঁকে প্রশ্ন করলে তিনি (ইবনু ওমর) বললেন-

'আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এভাবে খেজাব দিয়ে (দাঁড়ি) হলুদ করতে দেখেছি। তাঁর কাছে এর চেয়ে প্রিয় রঙ আর কিছুই ছিল না। তিনি এই রঙ দিয়ে তার সব পোশাক এমনকি পাগড়ি পর্যন্ত রঙ করে নিতেন। প্রয়োজনে চুলে রং করা ইসলাম নিষেধ করে না। তবে রং মেহেদি হোক বা আর্টিফিশিয়াল, চুলের ওপর এর আলাদা প্রলেপ যেন না পড়ে। রং যেন চুলে মিশে একাকার হয়ে যায়। মেয়েদের রং মাখার উদ্দেশ্য যদি পরপুরুষকে দেখানো হয়, তাহলে তা বৈধ নয়। রং শুধু নিজের সুন্দরতা, নারী মহলে চলাচল ও আপন পুরুষদের দেখানোর জন্য বৈধ হতে পারে। আপন পুরুষ মানে, যাদের সামনে শরিয়ত চুল খোলা রাখা জায়েজ রেখেছে। চুলে যদি আলাদা প্রলেপ না পড়ে, ফরজ গোসলের সময় যদি চুল ঠিকমতো ভিজে, রং যদি অস্তিত্বহীন হয়ে চুলে মিশে যায়, তাহলে এমন রং নিয়ে নামাজও হবে।

***বার্ধক্য গোপন করার জন্য বৃদ্ধের জন্য সাদা চুল-দাড়িতে কালো খেজাব ব্যবহার একেবারেই নাাজায়েজ। কালো খেজাব ব্যবহারকারী ব্যক্তি জান্নাতের ঘ্রাণও পাবে না। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘শেষ যুগে এমন এক সম্প্রদায়ের আবির্ভাব ঘটবে যারা (চুল-দাড়িতে) কবুতরের বুকের রঙের মতো কালো খেজাব বা কলপ ব্যবহার করবে। তারা জানানতের সুগন্ধও পাবে না। (আবু দাউদ : ৪২১২)। যারা চুল-দাড়িতে কালো রঙ ব্যবহার করবে তারা জান্নাত থেকে তো বঞ্চিত হবে আবার তাদেরকে ভয়াবহ শাস্তির হুশিয়ারিও দিয়েছেন মহানবী (সা.)। হজরত আবু দারদা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে নবীজি (সা.) বলেন, কালো কলপ ব্যবহারকারী ব্যক্তির চেহারা কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা কালো করে দেবেন।’ কেমিক্যালযুক্ত যে মেহেদির রং সম্পূর্ণ কালো সেটার নাম মেহেদি হলেও তা ব্যবহার নাজায়েজ। তবে কোনো খেজাব যদি একোবরে কালো না হয়ে মিশ্র রঙের হয তা ব্যবহার করা যেতে পারে।

সুরা রূমের ৩০ নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আল্লাহর সৃষ্টির কোনো পরিবর্তন নেই।’ অর্থাৎ প্রকৃতিগতভাবে আল্লাহর সৃষ্ট কোনো সৃষ্টিকে পরিবর্তন সাধন করা যাবে না। সাদা কিংবা কালো চুল-দাড়িও প্রকৃতিগতভাবে আল্লাহ তাআলার সৃষ্টি। তা পরিবর্তন হারাম। কালো রঙ দ্বারা পাকা চুল-দাড়িকে কালো করে নিজেকে যুবক কিংবা অপেক্ষাকৃত কম বয়সী জাহির করেন অনেকে। বার্ধক্যজনিত কারণে চুল-দাড়ি পেকে গেলে তা তো আশীর্বাদ। অনেকে পাকা চুল ও দাড়ি উঠিয়ে ফেলে যুবক সাজতে চান অথচ মুমিনের একটি চুল সাদা হলে একটি গুনাহ ঝড়ে যায়। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, নবীজি (সা.) বলেন, তোমরা পাকা চুল তুলে ফেলো না। কেননা পাকা চুল হলো মুসলমানের জ্যোতি। কোনো মুসলমানের একটি চুল পেকে গেল আল্লাহ তার জন্য একটি নেকি লিখে দেন, একটি মর্যাদা বৃদ্ধি করেন, একটি গুনাহ ক্ষমা করেন।’ (মুসনাদে আহমাদ : ৬৯৬২)।

বার্ধক্যজনিত কারণে সাদা হয়ে যাওয়া চুল-দাড়িতে কালো খেজাব ব্যবহারে নিষেধের মূল কারণ হলো, এর দ্বারা আল্লাহপ্রদত্ত বার্ধক্যকে গোপন করে মানুষের সামনে নিজেকে তরুণ হিসেবে উপস্থাপন করা। এর ফলে ব্যক্তিগত আচরণেও প্রভাব পড়ে। এটা এক ধরণের প্রতারণা। আল্লাহর ফায়সালাকে মেনে না নেওয়ার নামান্তর। তবে অসুস্থতা, চুলের যত্ন না নেওয়া, কোনো ওষুধ ব্যবহারের কারণে বা অন্য কোনো কারণে অপরিণত বয়সেই যে যুবকের চুল-দাড়ি সাদা হয়ে গেছে যেহেতু সে আসলে বৃদ্ধ নয়, এখানে বার্ধক্য গোপন করা হচ্ছে না তাই সে কালো খেজাব ব্যবহার বৈধ বলেই অকে আলেম মত দিয়েছেন। (ফায়জুল কাদির : ১/৩৩৬)। বার্ধক্যের আগেই সাদা হয়ে যাওয়া চুলে কোনো

কোনো পূর্ববর্তী আলেমও কালো খেজাব ব্যবহার করেছেন। ইমাম জুহরি (রহ.) বলেন, আমাদের চেহারা যখন সতেজ ছিল তখন আমরা কালো খেজাব ব্যবহার করেছি। কিন্তু যখন চেহারায় বার্ধক্যের ছাপ পড়েছে, চেহারা মলিন হয়ে গেছে, দাঁত নড়বড়ে হয়ে গেছে তখন আর কালো খেজাব ব্যবহার করিনি। (ফাতহুল বারি : ১০/৩৩৬)। তবে যেহেতু হাদিসে কালো খেজাবকে বিশেষভাবে নিষেধ করা হয়েছে তাই যুবকদের জন্য উচিত এ ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করে একেবারে কালো খেজাব ব্যবহার না করে লাল কালো মিশ্রিত খেজাব ব্যবহার করা। (তুহফাতুল অহওয়াজি : ৫/১৫৪)।

03/11/2020

👉পশ্চিমাদের কপটতা
মুসলমানদের সম্পর্কে পশ্চিমাদের সবচেয়ে বড় আপত্তি, মুসলমানরা খুব রাগী ও আবেগপ্রবণ। বিশেষত কুরআন মজীদ ও হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রশ্নে তারা খুবই সংবেদনশীল।

আমি বলি, পশ্চিমাদের কাছে যা আপত্তির বস্ত্ত, তা আমাদের কাছে গর্বের বিষয়। কারণ ক্রোধ একটি স্বভাবজাত প্রবণতা, মানুষের স্বভাবে রাগ-অনুরাগ এবং প্রীতি ও বিদ্বেষের যে প্রবণতাগুলো রয়েছে, তা আল্লাহ তাআলার দান এবং কোনোটিই অপ্রয়োজনীয় নয়। মানুষের কোনো অবস্থাতেই রাগান্বিত হওয়া উচিত নয়-এমন কথা মানবস্বভাবের সম্পূর্ণ বিরোধী। তবে অন্য সকল বিষয়ের মতো রাগ-অভিমান প্রকাশেরও নির্ধারিত ক্ষেত্র ও সীমারেখা আছে।

কেউ যদি দাবি করে যে, কোনো কিছুতেই তার রাগ উঠে না তাহলে সে একজন অসুস্থ মানুষ, তার আশু চিকিৎসা প্রয়োজন। একইভাবে কারো যদি সবকিছুতেই রাগ উঠে তাহলে তারও চিকিৎসার প্রয়োজন।

যার প্রতি আপনার ভালবাসা আছে, তার অসম্মান অবশ্যই আপনাকে ক্ষুব্ধ করবে। এটা প্রেম ও ভালবাসার স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া।

তাই একজন মুসলমান সে যতই বে-আমল হোক কুরআনের অসম্মান বরদাশত করবে না, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অবমাননা সহ্য করবে না। কুরআনের মর্যাদা রক্ষার জন্য, নবীর মর্যাদা রক্ষার জন্য একজন সাধারণ মুসলমানও জীবনের বাজি লাগাতে পারে। আজকের এই চরম অবক্ষয়ের যুগে এটিই আমাদের আসল পুঁজি। এটি নবীর প্রতি ভালবাসার প্রমাণ। দ্বীনের ভাষায় একেই বলে ঈমান।

পশ্চিমাদের আরেকটি অভিযোগ, দুনিয়ার সকল জাতি যখন খোদা, রাসূল ও ধর্মগ্রন্থের কথা ছেড়ে দিয়েছে তখনও মুসলমানরা সকল বিষয়ে আল্লাহর কথা বলে, রাসূলের কথা বলে।

তাদের এই অভিযোগও সত্য এবং এটাও আমাদের গর্বের বিষয়। আল্লাহর হাজার শোকর যে, আমাদের কাছে আল্লাহর কালাম ও আল্লাহর নবীর বাণী সুসংরক্ষিত আছে। শুধু তাই নয় আল্লাহর কালাম ও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী আমাদের কাছে এতই সুসংহত যে, বুশ, ওবামা ও টনি ব্লেয়ারকেও যদি মুসলমানদের সাথে কথা বলতে হয় তাহলে কুরআনে কারীমের কোনো আয়াত কিংবা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কোনো হাদীস মুখস্থ করে আসতে হয়।

আল্লাহর হাজার শোকর, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে শুধু যে আমাদের হৃদয়ের বন্ধন তা-ই নয়; বরং আজও আমাদের সবচেয়ে বড় উদ্ধৃত্তি কুরআন ও সুন্নাহ। এই আস্থা ও বিশ্বাসই পশ্চিমাদের মাথাব্যথার কারণ। তাই তা বিনষ্ট করার জন্য তারা মরণপন করেছে। দুইশ বছরেরও বেশি সময় যাবত তারা প্রাণান্ত চেষ্টা করেছে, কীভাবে মুসলমানের ঈমান ও আকীদা নষ্ট করা যায় এবং তাদের অন্তর থেকে এই আযমত ও মহববত দূর করা যায়। কিন্তু আলমহামদুলিল্লাহ, এখনও তারা সফল হতে পারেনি। ইনশাআল্লাহ কিয়ামত পর্যন্ত সফল হতে পারবেও না।

পশ্চিমা ও সেক্যুলার গোষ্ঠী আরো প্রচার করে যে, মুসলমানরা ভিন্নমত সহ্য করে না। এটা একটি মিথ্যা প্রোপাগান্ডা। কারণ চৌদ্দশত বছর ধরে মুসলিম মনীষীরা ঈমান-আকীদা, কুরআনে কারীম ও নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে অমুসলিমদের প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন। আজ পর্যন্ত কোনো মুসলমান কোনো অমুসলিমকে এই প্রশ্ন করেনি যে, সে কেন ইসলাম সম্পর্কে প্রশ্ন করছে? অতীতেও তাদের প্রশ্নের জবাব দেওয়া হয়েছে। এখনও দেওয়া হচ্ছে। আর বিগত প্রায় তিনশ বছর যাবত বিশেষভাবে ইসলামী আইন এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবন ও কর্ম নিয়ে পশ্চিমের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেই অধ্যয়ন ও গবেষণা হচ্ছে। অমুসলিমদের মতামত সামনে আসছে। মুসলিম গবেষকরাও যুক্তি-প্রমাণ দ্বারা নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরছেন। গ্রন্থের জবাবে গ্রন্থ এবং উদ্ধৃতির জবাবে উদ্ধৃতি সামনে আসছে। সুতরাং ভিন্নমত সহ্য করা হয় না-এ কথা অবাস্তব। ভিন্নমত নয়, মুসলমানরা যা সহ্য করেন না তা হচ্ছে অবমাননা। এটা অতীতেও সহ্য করা হয়নি, ভবিষ্যতেও করা হবে না।

এটা পশ্চিমাদের কপটতা যে, ভিন্ন মতের নামে তারা বিদ্বেষ চরিতার্থ করতে চায়, কোনো আত্মমর্যাদাশীল জাতি যা সহ্য করতে পারে না। ভিন্নমত ও অবমাননা এককথা নয়। তাই এর জবাবও একরকম হয় না।
***নবী-রাসুলরা সমালোচনার ঊর্ধ্বে

ইমাম ফখরুদ্দিন রাজি (রহ.) তাঁর ‘ইসমাতুল আম্বিয়া’ গ্রন্থের ভূমিকায় নবী-রাসুল (আ.)-এর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলি এবং তাঁদের জীবনের সার্বিক পবিত্রতা নিয়ে আলোচনা করেছেন। সেখানে তিনি যা বলেছেন তার সারকথা হলো, নবী-রাসুল (আ.) ছিলেন ত্রুটি ও বিচ্যুতি থেকে মুক্ত। তাঁদের চরিত্র ও আল্লাহভীতির ব্যাপারে সন্দেহ করার অবকাশ নেই। কেননা আল্লাহ তাঁর কুদরত ও ফেরেশতার মাধ্যমে তাঁদেরকে সব ধরনের ত্রুটি ও মানবিক দুর্বলতার ঊর্ধ্বে রেখেছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের মন্দ বৈশিষ্ট্য, পাপ ও অপরাধের অভিযোগ অপবাদ বা মিথ্যাচার ছাড়া কিছুই না। আল্লাহ যেমনটি বলেছেন, ‘তাদের মুখ থেকে যে বাক্য বের হয় তা কতই না জঘন্য। তারা তো কেবল মিথ্যাই বলে।’ (সুরা : কাহফ, আয়াত : ৫)



নবী-রাসুলদের সম্মান কেন রক্ষা করতে হবে

শরিয়তের মূলনীতি অনুযায়ী আল্লাহর প্রেরিত সব নবী ও রাসুল (আ.) সব ধরনের ত্রুটি-বিচ্যুতি ও পাপ-পঙ্কিলতামুক্ত। সুতরাং তাঁরা সমালোচনার ঊর্ধ্বে। তাঁদের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে মুসলিম গবেষকরা যেসব যুক্তি উপস্থাপন করেন তা হলো—

এক. আল্লাহকে দোষারোপ করা হয় : নবী-রাসুল (আ.) আল্লাহ কর্তৃক মনোনীত ও প্রেরিত। সুতরাং তাঁদের সমালোচনা ও দোষ-ত্রুটি চর্চা করা এবং তাঁদের অসম্মান করা আল্লাহর নির্বাচন ও মনোনয়নকে প্রশ্নবিদ্ধ করে এবং তার দায়ভারও আল্লাহর ওপর আরোপ করা হয়। (নাউজুবিল্লাহ) অথচ আল্লাহ সব ধরনের ভুল-ত্রুটি ও দুর্বলতার ঊর্ধ্বে।

দুই. আল্লাহ কর্তৃক পরিচালিত : নবী ও রাসুলদের সমগ্র জীবন সরাসরি আল্লাহ কর্তৃক পরিচালিত এবং তাঁর বরকতে ধন্য। ঈসা (আ.) সম্পর্কে বর্ণিত দুটি আয়াতে সে ইঙ্গিত লাভ করা যায়। ইরশাদ হয়েছে, ‘যেখানেই আমি থাকি না কেন তিনি আমাকে বরকতময় করেছেন।’ (সুরা : মারিয়াম, আয়াত : ৩১)

অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘আমার প্রতি শান্তি যেদিন আমি জন্মলাভ করেছি, যেদিন আমি মৃত্যুবরণ করব এবং যেদিন জীবিত অবস্থায় আমি উত্থিত হব।’ (সুরা : মারিয়াম, আয়াত : ৩৩)

তিন. নবী-রাসুলরা নিজ থেকে কিছু বলেন না : আল্লাহর প্রেরিত পুরুষরা দ্বিন প্রচারের ব্যাপারে নিজ থেকে কিছুই বলেন না; বরং আল্লাহর পক্ষ থেকে যা কিছু বলা হয় তাঁরা তা-ই প্রচার করেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমাদের সঙ্গী বিভ্রান্ত নয়, বিপদগ্রস্তও নয় এবং সে মনগড়া কথাও বলে না। এটা তো ওহি, যা তার প্রতি প্রত্যাদেশ হয়।’ (সুরা : নাজম, আয়াত : ২-৪)

চার. শয়তান ও প্রবৃত্তির প্রভাবমুক্ত : আল্লাহর মনোনীত পুরুষরা শয়তানের ধোঁকা ও কুপ্রবৃত্তির প্রভাবমুক্ত ছিলেন। কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘সে (ইবলিশ) বলল, হে আমার প্রতিপালক! আপনি যেমন আমাকে বিপথগামী করলেন তজ্জন্য আমি পৃথিবীতে মানুষের কাছে পাপ কাজকে শোভন করে তুলব এবং আমি তাদের সবাইকে বিপথগামী করব। তবে আপনার নির্বাচিত বান্দারা ছাড়া।’ (সুরা : হিজর, আয়াত : ৩৯-৪০)

চার. শয়তান ও প্রবৃত্তির প্রভাবমুক্ত : আল্লাহর মনোনীত পুরুষরা শয়তানের ধোঁকা ও কুপ্রবৃত্তির প্রভাবমুক্ত ছিলেন। কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘সে (ইবলিশ) বলল, হে আমার প্রতিপালক! আপনি যেমন আমাকে বিপথগামী করলেন তজ্জন্য আমি পৃথিবীতে মানুষের কাছে পাপ কাজকে শোভন করে তুলব এবং আমি তাদের সবাইকে বিপথগামী করব। তবে আপনার নির্বাচিত বান্দারা ছাড়া।’ (সুরা : হিজর, আয়াত : ৩৯-৪০)

হাদিসে এসেছে, জিন তথা শয়তানের ওপর রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বিজয়ী করা হয়েছে।

পাঁচ. মানবজাতির জন্য অবদান : পবিত্র কোরআনের ভাষ্য অনুযায়ী প্রথম নবী আদম (আ.)-এর মাধ্যমে মানবসভ্যতার সূচনা হয় এবং যুগে যুগে নবী-রাসুলরা সভ্যতার বিকাশে মানবজাতির নেতৃত্ব দেন। তাঁরা শুধু মানুষকে ধর্মীয় জীবন শেখাননি; বরং জ্ঞান-বিজ্ঞান ও পার্থিব জীবনের প্রয়োজনীয় বিষয়গুলোও শিক্ষা দিয়েছেন। তাঁদের দায়িত্ব ও অবদান সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, ‘তিনিই উম্মিদের মধ্যে একজন রাসুল পাঠিয়েছেন তাদের মধ্য থেকে যে তাদের কাছে পাঠ করে তার আয়াতগুলো, তাদের পবিত্র করে এবং শিক্ষা দেয় কিতাব ও হিকমাহ (প্রজ্ঞা)। ইতিপূর্বে তারা ছিল ঘোর বিভ্রান্তিতে।’ (সুরা : জুমা, আয়াত : ২)

03/11/2020

👉নবীদের সম্মান রক্ষা করা সবার দায়িত্ব

আল্লাহ তাআলা মানবজাতির হিদায়াতের জন্য যুগে যুগে রাসুল পাঠিয়েছেন। সেই ধারাবাহিকতায় আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) বিশ্ব মানবগোষ্ঠীর জন্য সর্বশেষ রাসুল। তিনি সকল জনগোষ্ঠীর জন্য প্রেরিত নবী। আরবী, অনারবী, সাদা-কালো সবার জন্য তিনি নবী ও রাসুল। তিনি সকল নবী ও রাসূলেরও নেতা।
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘অবশ্যই আল্লাহ মুমিনদের উপর অনুগ্রহ করেছেন, যখন তিনি তাদের মধ্য থেকে তাদের প্রতি একজন রাসুল পাঠিয়েছেন, যে তাদের কাছে তার আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করে এবং তাদেরকে পরিশুদ্ধ করে আর তাদেরকে কিতাব ও হিকমাত শিক্ষা দেয়। যদিও তারা ইতোপূর্বে স্পষ্ট ভ্রান্তিতে ছিল।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত : ১৬৪)
বর্তমানে বিভিন্নভাবে রাসুল (সা.) এর অবমাননা করা হচ্ছে, অথচ আমরা জানি না, এর পরিণাম কত ভয়াবহ। এ বিষয়ে আমাদের সঠিক জ্ঞান থাকা খুবই জরুরি। আলোচ্য প্রবন্ধে রাসুল সা. এর অবমাননার পরিণাম ও শাস্তি সম্পর্কে সামান্য আলোকপাত করার চেষ্টা করবো।
রাসুলর সম্মান ও মর্যাদা : মুহাম্মদ (সা.) এর সম্মান ও মর্যাদা আল্লাহ তাআলা নির্ধারণ করেছেন। তাই ইচ্ছা করে তার মর্যাদা কেউ বাড়াতে বা কমাতে পারবে না। তারা নবীকে নিয়ে যতই কটূক্তি এবং অবমাননা করেছে আল্লাহ ততই তার মর্যাদা বৃদ্ধি করেছেন।
আল্লাহ্ বলেন, ‘আর আমরা আপনার খ্যাতিকে উচ্চ মর্যাদা দান করেছি।’ (সুরা আল-ইনশিরাহ, আয়াত : ৪)

প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের আযানে বিশ্বব্যাপী মসজিদে মসজিদে তার নাম উচ্চারিত হচ্ছে। মুয়াজ্জিন ঘোষণা দিচ্ছে, ‘আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ্’ অর্থাৎ ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে মুহাম্মদ আল্লাহর রাসুল।’
নিম্নে রাসুল (সা.) এর সম্মান ও মর্যাদা সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো-
১. উত্তম চরিত্র ও মাধুর্যপূর্ণ আচরণের অধিকারী আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা.)ছিলেন উত্তম চরিত্র ও মাধুর্যপূর্ণ আচরণের অধিকারী। এ বিষয়ে স্বয়ং আল্লাহ তাআলাই প্রশংসা করে বলেন, ‘আর অবশ্যই তুমি মহান চরিত্রের উপর প্রতিষ্ঠিত।’ (সুরা আল-কালাম, আয়াত : ৪)
অনুরূপভাবে হরযত আবু হুরায়রা রা. বর্ণিত হাদীসে রাসুল (সা.) বলেন, ‘নিশ্চয় আমি মহৎ চারিত্রিক গুণাবলীর পূর্ণতা দান করার উদ্দেশ্যে প্রেরিত হয়েছি।’ (বায়হাকী)

২. তিনি বিশ্ববাসীর জন্য রহমাত স্বরূপ আল্লাহ তাআলা মুহাম্মদ (সা.) কে শুধু মানবমণ্ডলী নয়; সকল সৃষ্টিকুলের জন্যই রহমাত হিসেবে প্রেরণ করেছেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর আমি তোমাকে বিশ্ববাসীর জন্যে কেবল রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেছি।’ (সুরা আম্বিয়া, আয়াত : ১০৭)

৩. তিনি শেষ নবী তার বৈশিষ্ট্যের অন্যতম একটি দিক হচ্ছে, তিনি হচ্ছেন নবী পরস্পরা পরিসমাপ্তকারী-শেষ নবী। তারপর আর কোনো নবী আসবেন না। কুরআন মাজীদে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেন, ‘মুহাম্মদ তোমাদের কোনো পুরুষের পিতা নন, বরং তিনি আল্লাহর রাসুল এবং শেষ নবী। আর আল্লাহ সবকিছু সম্পর্কে সর্বজ্ঞ।’ (সুরা আল-আহযাব, আয়াত : ৪০)
৪. সকল নবী-রাসুলদের উপর তাকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করা হয়েছে যুগে যুগে যেসব নবী ও রাসুল আগমন করেছেন তাদের উপর মুহাম্মদ (সা.)কে শ্রেষ্ঠত্ব দেওয়া হয়েছে। হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদীসে নবী (সা.) বলেছেন, ‘ছয়টি দিক থেকে সকল নবীদের উপর আমাকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করা হয়েছে। আমাকে জাওয়ামিউল কালিম তথা ব্যাপক অর্থবোধক সংক্ষিপ্ত বাক্য বলার যোগ্যতা দেওয়া হয়েছে, আমাকে ভীতি (শত্রুর অন্তরে আমার ব্যাপারে ভয়ের সঞ্চার করা) দ্বারা সাহায্য করা হয়েছে, গনীমতের মাল (যুদ্ধলব্ধ সম্পদ) আমার জন্যে বৈধ করা হয়েছে, আমার জন্যে সকল ভূমিকে পবিত্র ও সিজদার উপযুক্ত করা হয়েছে, আমি সকল মানুষের তরে প্রেরিত হয়েছি এবং আমার মাধ্যমে নবুওয়ত পরস্পরা শেষ করা হয়েছে।’ (সহীহ মুসলিম, হাদিস নং : ১১৯৫)
৫. তাকে নিজের জীবনের চেয়েও বেশি ভালবাসা ঈমানের দাবি যে ব্যক্তির মধ্যে রাসূলের ভালবাসা থাকবে না, সে কোনো দিন মুমিন হতে পারবে না। এমনকি নিজের জীবন থেকেও তার প্রতি বেশি ভালবাসা থাকতে হবে। কুরআনে বলা হয়েছে, ‘নবী, মুমিনদের কাছে তাদের নিজদের চেয়ে ঘনিষ্ঠতর।’ (সুরা আল-আহযাব, আয়াত : ৬)
হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণনা করেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না আমি তার কাছে তার সন্তান, পিতা ও সমগ্র মানুষ হতে প্রিয়তম হবো।’ অর্থাৎ সবার চেয়ে তাকে বেশি ভালবাসতে হবে। (সহীহ বুখারী)
৬. তার শাফাআত (সুপারিশ) কবুল হবে কিয়ামাতের কঠিন মুসিবতের দিনে আল্লাহ তাআলার অনুমতিক্রমে তিনি গুনাহগার উম্মাতের জন্য শাফাআত করবেন। হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) বর্ণিত হাদীসে রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘কিয়ামতের দিন আমি সকল আদম সন্তানের নেতা। এতে কোনো গর্ব-অহঙ্কার নেই। সেদিন আমার হাতে প্রশংসার ঝাণ্ডা থাকবে তাতে কোনো গর্ব-অহঙ্কার নেই। আদম থেকে নিয়ে যত নবী-রাসুল আছেন সকলেই আমার ঝাণ্ডার নীচে থাকবেন। আমি হচ্ছি প্রথম সুপারিশকারী এবং আমার সুপারিশই সর্বপ্রথম কবুল করা হবে। এতে কোনো গর্ব-অহঙ্কার নেই। সেদিন আমার হাতে প্রশংসার ঝাণ্ডা থাকবে তাতে কোনো গর্ব-অহঙ্কার নেই। আদম থেকে নিয়ে যত নবী-রাসুল আছেন সকলেই আমার ঝাণ্ডার নীচে থাকবেন। আমি হচ্ছি প্রথম সুপারিশকারী এবং আমার সুপারিশই সর্বপ্রথম কবুল করা হবে। এতে কোনো গর্ব-অহঙ্কার নেই।’ (ইবন মাজাহ)
৭. তিনিই সর্বপ্রথম জান্নাতে প্রবেশকারী ব্যক্তি তিনিই সর্বপ্রথম জান্নাতে প্রবেশকারী ব্যক্তি হবেন। এ বিষয়ে হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত হাদীসে এসেছে, রাসুল (সা.) বলেন, ‘জান্নাতের দরজায় আমিই সর্বপ্রথম করাঘাত করব, তখন খাযেন (প্রহরী) জিজ্ঞেস করবে, কে আপনি? আমি বলব, মুহাম্মদ। সে বলবে, আপনার জন্যেই খোলার ব্যাপারে নির্দেশিত হয়েছি, আপনার পূর্বে কারো জন্যে খুলব না।’ (মুসলিম)
৮. তার আদর্শই সর্বোত্তম যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি, জান্নাতের আশা এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি প্রত্যাশা করেন তিনি তাদের সকলের জন্যে উত্তম আদর্শ। কুরআন মাজীদে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে তাদের জন্যে রাসুলর মাঝেই রয়েছে উত্তম আদর্শ।’ (সুরা আল-আহযাব, আয়াত : ২১)
৯. সকল ক্ষেত্রে তার অনুসরণ ঈমানদার হওয়ার শর্ত তিনি যেসব বিষয়ে আদেশ করেছেন তা পালন করা এবং যা নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাকতে হবে। কেননা তা ঈমানদার হওয়ার শর্ত। কুরআনে মাজীদে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর রাসুল তোমাদের জন্য যা দিয়েছেন তা তোমরা গ্রহণ কর, আর যা থেকে সে তোমাদের নিষেধ করে তা থেকে বিরত হও।’ (সুরা হাশর, আয়াত : ৭)
হযরত আবদুল্লাহ ইবন আমর (রা.) থেকে বর্ণনা করেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ পরিপূর্ণ মুমিন হতে পারবে না যতক্ষণ না তোমাদের প্রবৃত্তি আমার অনুসরণ করে।’
১০. তার নাম শুনলে দুরুদ ও সালাম দিতে হয় আল্লাহ তাআলা তার মর্যাদাকে সমুন্নত করার জন্য দুরুদ ও সালাম পাঠের নির্দেশ প্রদান করেছেন। সুরা আল-আহযাবের ৫৬ নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘হে মুমিনগণ, তোমরাও নবীর উপর দরূদ পাঠ কর এবং তাকে যথাযথভাবে সালাম জানাও।’
অনুরূপভাবে যহরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমার উপর একবার দুরুদ পাঠ করবে আল্লাহ তাকে দশবার দুরুদ পাঠ করেন, দশটি গুনাহ মুছে দেবেন এবং দশটি মর্যাদায় ভূষিত করবেন।’ (সুনান নাসাঈ)
১১. তার উপর কুরআন অবতীর্ণ করা হয়েছে আল্লাহ তাআলা যুগে যুগে মানবতার হিদায়াতের জন্য যেসব কিতাব অবতীর্ণ করেছেন, তার মধ্যে আল-কুরআন হলো সর্বশেষ আসমানী কিতাব, যা মুহাম্মদ (সা.) এর উপর অবতীর্ণ হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর যারা ঈমান এনেছে, সৎকর্ম করেছে এবং মুহাম্মাদের প্রতি যা নাযিল করা হয়েছে তাতে ঈমান এনেছে, আর তা তাদের রবের পক্ষ হতে (প্রেরিত) সত্য, তিনি তাদের থেকে তাদের মন্দ কাজগুলো দূর করে দেবেন এবং তিনি তাদের অবস্থা সংশোধন করে দেবেন।’ (সুরা মুহাম্মদ, আয়াত : ২)

***রাসুল (সা.) এর অবমাননা
বিশ্ব মানবণ্ডলীর হিদায়াতের জন্য আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা.) কে প্রেরণ করা হয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য এই যে, তিনি বিভিন্ন সময় নানা রকমের বাধা বিপত্তি ও অবমাননার শিকার হয়েছেন। এ বিষয়ে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর এমনিভাবেই আমরা প্রত্যেক নবীর জন্যে বহু শয়তানকে শত্রুরূপে সৃষ্টি করেছি, তাদের কতক শয়তান মানুষের মধ্যে এবং কতক শয়তান জ্বীনদের মধ্য থেকে হয়ে থাকে, এরা একে অপরকে কতগুলো মনোমুগ্ধকর, ধোঁকাপূর্ণ ও প্রতারণাময় কথা দ্বারা প্ররোচিত করে থাকে, আর আপনার রবের ইচ্ছা হলে তারা এমন কাজ করতে পারত না, সুতরাং আপনি তাদেরকে এবং তাদের মিথ্যা রচনাগুলোকে বর্জন করে চলুন।’ (সুরা আল-আনআম, আয়াত : ১১২)
তার উপর নবুওয়তী জীবনের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত বিভিন্ন রকমের কটূক্তি, অবমাননা এমনকি তার পরিবারের উপর অপবাদ দেওয়া হয়েছে। তার নাম বিকৃতি করা, তার চরিত্র নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করা, বিভিন্ন ইবাদাত নিয়ে ব্যঙ্গ করাসহ নানাভাবে পত্রিকা, ব্লগ, ফেসবুক ও বিভিন্ন মিডিয়ায় তাকে অবমাননা করা হচ্ছে। রাসুল (সা.) এর অবমাননা কত বড় জঘন্য অপরাধ তা নিম্নোক্ত বিষয় থেকে আরও সুস্পষ্ট হয়।
১. মানবাধিকার লঙ্ঘন রাসুল (সা.) এর উপর অপবাদ ও তাওর ব্যাপারে কুৎসা রটনা মানবাধিকার লঙ্ঘন। এ ধরনের জঘন্য কাজ কোনো বিবেকবান মানুষ করতে পারে না। যারা এ ধরণের কাজে লিপ্ত থাকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে তাদেরেকে দণ্ডিত হতে হবে।

২. রাসূলের অবমাননা অনৈতিক কাজ মুহাম্মদ (সা.) তার কর্মময় জীবনে সদা ব্যস্ত ছিলেন কীভাবে মানুষের কল্যাণ লাভ করা যায়। তার গোটা জীবন ছিল মানব কল্যাণে নিবেদিত। অপরের কষ্ট সহ্য করতেন না তিনি। কুরআনুল কারীমে এসেছে, ‘তোমাদের নিকট একজন রাসুল এসেছে, যে তোমাদের মধ্যেরই একজন। তোমাদের ক্ষতি হওয়া তার পক্ষে দুঃসহ কষ্টদায়ক, তোমাদের সার্বিক কল্যাণেরই সে কামনাকারী। ঈমানদার লোকদের জন্য সে সহানুভূতি সম্পন্ন ও করুণাসিক্ত।’ (সুরা আত-তাওবাহ্, আয়া : ১২৮]

৩. রাসূলের অবমাননা শাস্তিযোগ্য অপরাধ নবী (সা.)কে অবজ্ঞা করা, তুচ্ছ জ্ঞান করা, তার শানে বেয়াদবি করা অর্থাৎ তার প্রতি অবমাননাকর কোনো উক্তি করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
এ প্রসঙ্গে প্রসিদ্ধ আলেম কাজী ইয়ায (রহ.) বলেন, ‘উম্মতের ওলামায়ে কেরাম এ ব্যাপারে একমত যে, রাসুল (সা.) কে গালি দেওয়া বা তাকে অসম্মান করার শাস্তি হচ্ছে হত্যা করা। এ ব্যাপারে সকলের ইজমা হয়েছে যে, যে ব্যক্তি রাসুল (সা.) কে গালি দিবে বা তার অসম্মান করবে সে কাফের হয়ে যাবে এবং তার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।’ (আস-সারিমুল মাসলূল :১/৯)

৪. রাসূলের প্রতি অবমাননা একটি ফিতনাহ রাসুল (সা.) এর শানে অবমাননা একটি ফিতনাহ-ফাসাদ তুল্য অপরাধ। কারণ এর লক্ষ্য হল মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা ও সমাজে অশান্তি তৈরি করা। ভিন্নধর্মাবলম্বীদের প্রতি হিংসার আগুন জ্বালিয়ে দেওয়াসহ ধর্মপ্রিয় মানুষকে আঘাত করা।

৫. রাসূলের অবমাননা একটি যুলুম চরিত্র হচ্ছে মানব জীবনের এক অমূল্য সম্পদ। রাসুল (সা.) ছিলেন সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী। যে রাসূলের চারিত্রিক সার্টিফিকেট স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামীন দিয়েছেন তার ব্যাপারে অবমাননাকর উক্তি করা চরম যুলুম ভিন্ন অন্য কিছুই নয়। সুতরাং তার চরিত্রের বিরুদ্ধে কথা বলা কত বড় যুলুম তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

***রাসুল (সা.) এর অবমাননার পরিণাম ও শাস্তি
একজন মুমিনের কাছে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সম্মান ও মর্যাদা দুনিয়ার যাবতীয় সম্পদ ও সম্পর্ক থেকে অধিক মূল্যবান হতে হবে। রাসূলের অবমাননা ও বিরুদ্ধাচরণের বিষয়ে কোনো ঈমানদার আপস করতে পারেন না। কারণ রাসূলের বিরুদ্ধাচরণকারীদের সম্পর্কে কুরআন মজীদ কঠিন ভাষা ব্যবহার করেছে। সূরা মুজাদালায় (আয়াত : ২২) আল্লাহ তাআলা বলেছেন, (তরজমা) ‘যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে তারা চরম লাঞ্ছিতদের অন্তর্ভুক্ত হবে। আল্লাহ সিদ্ধান্ত করেছেন, অবশ্যই আমি বিজয়ী হব এবং আমার রাসূলগণও। নিশ্চয়ই আল্লাহ শক্তিমান, পরাক্রমশালী।

‘তুমি পাবে না আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাসী কোনো সম্প্রদায়কে, যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধাচরণকারীদের ভালবাসে, যদিও এই বিরুদ্ধাচরণকারীরা হয় তাদের পিতা, পুত্র, ভাই কিংবা জ্ঞাতি-গোত্র। ওদের অন্তরে আল্লাহ ঈমানকে সুদৃঢ় করেছেন এবং তাদেরকে শক্তিশালী করেছেন তাঁর পক্ষ হতে ‘রূহ’ দ্বারা ...।’

সূরাতুল কাউসারের শেষ আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, (তরজমা) ‘নিঃসন্দেহে তোমার শত্রুই হবে নির্বংশ।’

আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে শত্রুতা ও বিদ্বেষ পোষণকারীদের অবস্থা এবং এদের বিষয়ে মুমিন-মুসলমানের অবস্থান বোঝার জন্য এ দুটি আয়াতই যথেষ্ট।

রিসালাত-অবমাননার শাস্তি সম্পর্কে সবার আগে যে কথাটি স্পষ্টভাবে বলতে চাই তা এই যে, এটি কোনো ইজতিহাদী মাসআলা নয়; বরং কুরআন-সুন্নাহর দ্বারা সুপ্রমাণিত ও সুস্পষ্ট একটি বিষয়।

কুরআন মজীদের একাধিক আয়াত থেকে পরিষ্কার বোঝা যায় যে, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শানে বেয়াদবির শাস্তি দুনিয়াতে মৃত্যুদন্ড। আর আখেরাতে জাহান্নামের আযাব।

এ প্রসঙ্গে সূরা ফুরকানের কয়েকটি আয়াত তুলে ধরছি।

আল্লাহ তাআলা বলেন, (তরজমা) এবং যালিম সেদিন নিজের দুই হাতে দংশন করবে এবং বলবে, হায়! আমি যদি রাসূলের সাথে একই পথ অবলম্বন করতাম!

হায় দুর্ভোগ আমার! আমি যদি অমুককে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করতাম। সে তো আমাকে বিভ্রান্ত করেছিল আমার নিকট উপদেশ পৌঁছার পর। আর শয়তান তো মানুষের জন্য মহাপ্রতারক। (সূরা ফুরকান : ২৭-২৯)

হাদীসের কিতাবে আছে যে, উবাই ইবনে খালাফের প্ররোচনায় উকবা ইবনে আবী মুয়াইত রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শানে গোসতাখি করেছিল। তখন রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে সতর্ক করেছিলেন যে, মক্কার বাইরে তোমাকে পেলে তোমাকে হত্যা করব। বদরের যুদ্ধে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বন্দি অবস্থায় হত্যা করেছিলেন।

অন্য আয়াতে যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এবং পৃথিবীতে অশান্তি ও অরাজকতা সৃষ্টি করে তাদের শাস্তি ঘোষণা করে বলা হয়েছে, (তরজমা) যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করে বেড়ায় তাদের শাস্তি এটাই যে, তাদেরকে হত্যা করা হবে অথবা শূলে চড়ানো হবে। অথবা বিপরীত দিক হতে তাদের হাত-পা কেটে ফেলা হবে। অথবা দেশ হতে নির্বাসন দেওয়া হবে। এটা তাদের পার্থিব লাঞ্ছনা আর পরকালে তো তাদের জন্য রয়েছে মহাশাস্তি। (সূরা মায়েদা : ৩৩)

ওই ব্যক্তির চেয়ে অধিক অশান্তি সৃষ্টিকারী আর কে হতে পারে, যে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শানে গোসতাখি করে?

আল্লাহ তাআলা আরো বলেন, (তরজমা) তারা যদি চুক্তি সম্পন্ন করার পর নিজেদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে এবং তোমাদের দ্বীনের নিন্দা করে তাহলে তোমরা কাফির-সর্দারদের সাথে যুদ্ধ কর। এরা এমন লোক, যাদের প্রতিশ্রুতির কোনো মূল্য নেই। যেন তারা নিবৃত্ত হয়। (সূরা তাওবা : ১২)

এই আয়াত স্পষ্ট ঘোষণা করে যে, দ্বীনের নিন্দা হত্যাযোগ্য অপরাধ। সুতরাং যে রাসূলের নিন্দা-সমালোচনা করে তার শাস্তি মৃত্যুদন্ড। তার সাথে মুসলমানদের কোনো চুক্তি বা অঙ্গিকার থাকলে রাসূল-অবমাননার কারণে তা বাতিল হয়ে যায়।

হাদীসের কিতাবে এমন অনেক ঘটনা আছে যে, স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রিসালত-অবমাননাকারীকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করেছেন। এ থেকেও প্রমাণ হয় যে, রিসালাত-অবমাননার দুনিয়াবী সাজা মৃত্যুদন্ড।

[এরপর লেখক ইহুদি কাব ইবনে আশরাফ ও আবু রাফের হত্যার ঘটনা, একজন অন্ধ সাহাবী কর্তৃক তার দাসীকে হত্যার ঘটনা এবং উমাইর ইবনে আদী কর্তৃক আসমা বিনতে মারওয়ানকে হত্যার ঘটনা উল্লেখ করেছেন।]

তাওবার দ্বারা কি রিসালাত-অবমাননার সাজা মওকুফ হতে পারে? এর উত্তর এই যে, খাঁটি তাওবা মানুষকে আখিরাতের আযাব থেকে মুক্তি দিবে। কিন্তু অন্যান্য অপরাধের মতো রাসূল-অবমাননার অপরাধ যখন আদালত পর্যন্ত গড়ায় কিংবা জনসাধারণের মাঝে প্রচারিত হয়ে যায় তখন তার শাস্তি মওকুফের অবকাশ নেই। সত্য বা মিথ্যা তাওবার দ্বারা যদি ব্যভিচার, মিথ্যা অপবাদ, চুরি, মদ্যপান ও হত্যার শাস্তি মওকুফ না হয় তাহলে এসবের চেয়েও গর্হিত ও মারাত্মক অপরাধ-রিসালাত-অবমাননার শাস্তি শুধু তাওবা দ্বারা কীভাবে মওকুফ হতে পারে?
নিম্নে রাসূলের অবমাননার পরিণাম সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো-

১. কাফের ও মুরতাদ বা ধর্মত্যাগি হয়ে যাবে যে রাসূলের অবমাননা করবে সে মুরতাদ বা ধর্মত্যাগি এবং কাফির হিসেবে বিবেচিত হবে। এ বিষয়ে কুরআন মাজীদে বলা হয়েছে, ‘মুনাফিকরা ভয় করে যে, তাদের বিষয়ে এমন একটি সুরা অবতীর্ণ হবে, যা তাদের অন্তরের বিষয়গুলি জানিয়ে দেবে। বল, তোমরা উপহাস করতে থাক। নিশ্চয় আল্লাহ বের করবেন, তোমরা যা ভয় করছ। আর যদি তুমি তাদেরকে প্রশ্ন কর, অবশ্যই তারা বলবে, আমরা আলাপচারিতা ও খেল-তামাশা করছিলাম। বল, আল্লাহ, তার আয়াতসমূহ ও তার রাসূলের সঙ্গে তোমরা বিদ্রূপ করছিলে? তোমরা ওযর পেশ করো না। তোমরা তোমাদের ঈমানের পর অবশ্যই কুফরি করেছ। যদি আমি তোমাদের থেকে একটি দলকে ক্ষমা করে দেই, তবে অপর দলকে আযাব দেব। কারণ, তারা হচ্ছে অপরাধী।’ (সুরা আত-তাওবাহ, আয়াত : ৬৫-৬৬)

২. দুনিয়াতে আল্লাহর লানতপ্রাপ্ত ও আখিরাতে কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হবে যে রাসূলের অবমাননা করবে সে দুনিয়াতে আল্লাহর লানতপ্রাপ্ত ও আখিরাতে কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হবে। এ বিষয়ে কুরআন মাজীদে বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয় যারা আল্লাহ্ ও তার রাসুলকে কষ্ট দেয়, আল্লাহ্ তাদের প্রতি দুনিয়া ও আখিরাতে অভিসম্পাত করেন এবং তাদের জন্য প্রস্তুত রেখেছেন অবমাননাকর শাস্তি।’ (সুরা আল-আহযাব, আয়াত : ৫৭)
আর রাসুলকে অবমাননা এবং তাকে বিদ্রূপ করার মাধ্যমে তাকে সবচেয়ে বেশি কষ্ট দেওয়া হয়। এ বিষয়ে হাদীসে এসেছে, হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘এক ব্যক্তি নাসারা (খ্রিস্টান) ছিল সে ইসলাম গ্রহণ করল এবং সুরা আল-বাকারা ও আল ইমরান শিখল। সে নবী (সা.) এর নিকট কেরানীর কাজ করত। সে পুনরায় নাসারা হয়ে গেল এবং বলতে লাগল মোহাম্মদ আমি যা লিখি তাই বলে, এর বাহিরে সে আর কিছুই জানে না। এরপর সে মারা গেল, তখন তার সঙ্গীরা তাকে দাফন করল, সকালে উঠে দেখল তার লাশ বাইরে পড়ে আছে, তখন নাসারারা বলতে লাগল, মোহাম্মদের সঙ্গীরা এই কাজ করেছে; কেননা সে তাদের ধর্ম ত্যাগ করেছিল। তখন তারা আরো গভীর করে কবর খনন করে তাকে আবার দাফন করল, আবার সকালে উঠে দেখল তার লাশ বাইরে পড়ে আছে। তখন তারা বলল, এটা মোহাম্মদ এবং তার সঙ্গীদের কাজ, কেননা সে তাদের ধর্ম ত্যাগ করে এসেছিল। তখন তারা আবার আরো গভীর করে কবর খনন করল এবং তাকে দাফন করল, আবার সকালে উঠে দেখল তার লাশ আবার বাইরে পড়ে আছে, তখন তারা বুঝল, এটা কোনো মানুষের কাজ নয়, তখন তারা তার লাশ বাইরেই পড়ে থাকতে দিল।’ (বুখারী ও মুসলিম)

৩. মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হবে যদি কোনো ব্যক্তি বিচারের মাধ্যমে প্রমাণিত হয় যে, সে রাসূলের অবমাননা করেছে, তবে তাকে মুরতাদ হিসেবে সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে। এ বিষয়ে উম্মাতের সকল আলেম একমত হয়েছেন। কারণ, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি তার দ্বীন (ইসলামকে) পরিবর্তন করলো তাকে তোমরা হত্যা কর।’ (বুখারী, তিরমিযী, ১৪৫৮, আবু দাউদ: ও নাসাঈ)
রাসুল (সা.)কে নিয়ে কটাক্ষ ও বিদ্রূপ করার কারণে একজন সাহাবী তার নিজ দাসীকেও হত্যা করেছে এবং রাসুল (সা.) জেনে খুশি হয়েছেন। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে এভাবে, হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘একজন অন্ধ ব্যক্তির একটি উম্মে ওয়ালাদ (যে দাসীর গর্ভে মালিকের সন্তান জন্মগ্রহণ করেছে) দাসী ছিল। ঐ দাসী রাসুল (সা.)কে অযথা কটূক্তি করতো। অন্ধ ব্যক্তি তাকে বিরত থাকার নির্দেশ দিতেন ও নিবৃত করার চেষ্টা করতেন। কিন্তু দাসী কিছুতেই বিরত হতো না। এক রাতে দাসী রাসুল (সা.)কে নিয়ে কটূক্তি ও গালি-গালাজ করতে লাগলো। তখন লোকটি একটি কোদাল দিয়ে তার পেটে আঘাত করলো এবং তাকে হত্যা করলো। এ অবস্থায় তার একটি সন্তান তার দু’পায়ের মাঝখানে পড়ে গেল এবং রক্তে ভিজে গেল। সকাল বেলা রাসুল (সা.) এর কাছে বিষয়টি জানানো হলে রাসুল (সা.) লোকদের জড়ো করলেন এবং ঘোষণা দিলেন, আল্লাহর কসম! যে ব্যক্তি আমার জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ করেছে সে যেন অবশ্যই দাঁড়ায়। তার প্রতি আমারও একটি হক রয়েছে। তখন অন্ধ লোকটি কাঁপতে কাঁপতে মানুষের কাঁতার ভেদ করে রাসুল (সা.) এর কাছে গিয়ে বসে পড়লো। অতঃপর লোকটি বললো, ইয়া রাসুলাল্লাহ! ঐ ঘটনার ব্যক্তিটি আমি। আমার দাসীটি আপনাকে গালি-গালাজ করতো এবং অযথা তর্কে লিপ্ত হতো। আমি তাকে বারণ করলেও সে বারণ হতো না। তার থেকে আমার মুক্তোর মতো দু’টি ছেলে রয়েছে। তার সঙ্গে আমার দীর্ঘ দিনের সুসম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু গতরাতে সে যখন আপনাকে গালমন্দ করতে লাগলো আমি তখন তাকে একটি কোদাল নিয়ে তার পেটে আঘাত করি এবং তাকে হত্যা করি। রাসুল (সা.) উপস্থিত লোকদের বললেন, তোমরা সাক্ষি থাক! তার রক্ত মূল্যহীন ঘোষণা করা হলো (তাকে হত্যা করার জন্য হত্যাকারী অন্যায়কারী হিসেবে বিবেচিত হবে না)।’ (আবু দাউদ ৪৩৬৩, ত্বাবারানী ১১৯৮৪, বুলুগুল মারাম ১২০৪, দারাকুতনী ৮৯)
৪. শাস্তি না দিলে গোটা জাতি আল্লাহর গযবে পতিত হবে রাসুলের অবমাননা করার পর যদি সামর্থ থাকার পরও শাস্তি না দেওয়া হয় তবে গোটা জাতি আল্লাহর গযবে পতিত হবে। আল-কুরআনের সুরা আন-নূরের ৬৩ নং আয়াতে এসেছে, ‘অতএব যারা তার নির্দেশের বিরুদ্ধাচরণ করে তারা যেন তাদের ওপর বিপর্যয় নেমে আসা অথবা যন্ত্রণাদায়ক আযাব পৌঁছার ভয় করে।’

৫. তার সমস্ত আমল বরবাদ হয়ে যাবে তার সমস্ত আমল বরবাদ হয়ে যাবে। যারা রাসুলের অবমাননার কাজে জড়িত থাকবে তাদের সমস্ত আমল বরবাদ হয়ে যাবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর যে তোমাদের মধ্য থেকে তার দ্বীন থেকে ফিরে যাবে, অতঃপর কাফির অবস্থায় মৃত্যু বরণ করবে, বস্তুত এদের আমলসমূহ দুনিয়া ও আখিরাতে বিনষ্ট হয়ে যাবে এবং তারাই আগুনের অধিবাসী।’ (সুরা আল-বাকারাহ, আয়াত : ২১৭)
***রিসালত-অবমাননার মূলে বিদ্বেষ ও প্রতিহিংসা
নবীর মহাববত মুমিনের দ্বীন ও ঈমানের অংশ এবং তিনি ঈমানদারের জীবন ও কর্মের আদর্শ।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মহববত ও ভালবাসা কেবল আবেগের বিষয় নয়, দ্বীন ও ঈমানের বিষয়।

কুরআন মজীদের বিভিন্ন জায়গায় এ কথা বলা হয়েছে। এক আয়াতে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, (তরজমা) বলুন, তোমাদের পিতা, তোমাদের পুত্র, তোমাদের ভাই, তোমাদের স্ত্রী, তোমাদের আত্মীয়-স্বজন এবং ওই সম্পদ, যা তোমরা উপার্জন কর এবং ব্যবসা-বাণিজ্য যার ক্ষতির আশঙ্কা তোমরা কর এবং ঐ ঘর-বাড়ি, যাতে তোমরা বসবাস কর, যদি তোমাদের কাছে আল্লাহর চেয়ে, তাঁর রাসূলের চেয়ে এবং তাঁর রাস্তায় জিহাদের চেয়ে অধিক প্রিয় হয়ে থাকে তাহলে অপেক্ষা কর আল্লাহর বিধান আসা পর্যন্ত। আল্লাহ সত্যত্যাগী সম্প্রদায়কে সৎপথ প্রদর্শন করেন না। (সূরা তাওবা : ২৪)

অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, (তরজমা) রাসূল তোমাদেরকে যা দেন তা গ্রহণ কর আর যা নিষেধ করেন তা থেকে বিরত থাক। আল্লাহকে ভয় কর, নিশ্চয়ই আল্লাহর শাস্তি অত্যন্ত কঠিন। (সূরা হাশর : ৭)

আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আদেশ সমর্পিত চিত্তে মেনে নেওয়াই ঈমানের আলামত।

ইরশাদ হয়েছে, (তরজমা) মুমিনদের উক্তি তো এই-যখন তাদের মধ্যে ফয়সালা করার জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে আহবান করা হয় তখন তারা বলে, আমরা শ্রবণ করলাম এবং আনুগত্য করলাম। আর ওরাই তো সফলকাম। (সূরা নূর : ৫১)

হাদীস শরীফে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, (তরজমা) তোমরা কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না যতক্ষণ পর্যন্ত আমি তার কাছে তার পিতা থেকে, পুত্র থেকে এবং সকল মানুষ থেকে অধিক প্রিয় না হই। (হযরত আনাস রা.-এর সূত্রে, বুখারী, কিতাবুল ঈমান, হাদীস : ১৫; মুসলিম, কিতাবুল ঈমান, হাদীস : ১৭৭)

কুরআন ও হাদীসের এই সুস্পষ্ট নির্দেশনা সর্বযুগে মুমিনের চেতনাকে জাগ্রত রেখেছে। তারা আল্লাহর নবীকে প্রাণের চেয়েও অধিক ভালবেসেছেন এবং সমর্পিত চিত্তে তাঁর আনুগত্য করেছেন। অন্যদিকে ঈমানের দৌলত থেকে বঞ্চিত লোকেরাই আল্লাহর নবীকে ত্যাগ করেছে এবং বিদ্বেষ ও প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে তাঁর বিরোধিতা করেছে। তাই খোদাদ্রোহীদের রাসূল-অবমাননার ঘটনা নতুন নয়। আর তাদের পরিণতিও কারো অজানা নয়। স্বয়ং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগেও রিসালত-অবমাননার ঘটনা ঘটেছে এবং নবী-প্রেমিক সাহাবীগণ তার সমুচিত জবাব দিয়েছেন।

হাদীসের কিতাবে একজন অন্ধ সাহাবীর ঘটনা আছে। তার দাসী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শানে গোসতাখি করত। সাহাবী তাকে নিষেধ করতেন। একদিন সে যখন আবার গোসতাখি করল তো সাহাবী তাকে তরবারি দিয়ে শেষ করে দিলেন। ঘটনাটি শোনার পর হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘দামুহা হাদরুন।’ অর্থাৎ এ হত্যার কোনো শাস্তি নেই।

ইহুদি-নেতা কাব ইবনে আশরাফ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শানে গোসতাখি করত এবং নিন্দা ও উপহাসমূলক কবিতা পাঠ করত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আদেশে মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামা রা. তাকে খতম করেছেন। (সহীহ বুখারী, হাদীস : ৪০৩৭)

মদীনা মুনাওয়ারায় আবু ইফক নামক এক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিন্দা করে কবিতা রচনা করেছিল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আদেশে সালিম ইবনে উমাইর রা. তাকে হত্যা করেছেন। (সীরাতে ইবনে হিশাম ৪/২৮২)
ফতহে মক্কার সাধারণ ক্ষমার সময়ও ইবনে খাতালকে ক্ষমা করা হয়নি। সে আত্মরক্ষার জন্য কাবা ঘরের গিলাফ ধরে রেখেছিল। ঐ অবস্থায় তাকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আদেশে হত্যা করা হয়। তার দুই দাসীকেও মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়েছিল, যারা ইবনে খাতাল রচিত কবিতা লোকদের আবৃত্তি করে শোনাত। (সহীহ বুখারী, হাদীস : ৪০৩৫; আলকামিল ইবনুল আছীর ২/১৬৯)

নবী-যুগের এইসব ঘটনা প্রমাণ করে যে, তাওহীনে রিসালাত বা রাসূল-অবমাননা (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) একটি চরম অপরাধ, যার শাস্তি মৃত্যুদন্ড। উম্মাহর চার ইমাম এ বিষয়ে একমত। আল্লামা শামী রাহ. বলেন, ‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে কটুক্তিকারী ঈমান থেকে খারিজ ও হত্যার উপযুক্ত। চার ইমাম এ বিষয়ে একমত।’

ইসলামের বিজয়ের যুগে যখন মুসলমানদের আইন-আদালত অমুসলিমদের প্রভাব-প্রতিপত্তি থেকে মুক্ত ছিল তখন এ ধরনের অপরাধী মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত হত। এমনকি ইতিহাসে আছে যে, নবম শতকের মাঝামাঝিতে আন্দালুসে এক খ্রিস্টানের নেতৃত্বে কিছু লোক দলবদ্ধভাবে রাসূলের অবমাননায় লিপ্ত হয়েছিল। মুসলিম বিচারকরা সে সময় বিন্দুমাত্র ছাড় দেননি। এদের মৃত্যুদন্ড দেওয়ার কারণে স্পেন থেকে এই ফিতনা বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। (দেখুন : তারীখে হিসপানিয়া ১/২০০)

খ্রিস্টজগতের সাথে মুসলিমজাহানের দ্বন্দ-সংঘাতের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। খ্রিস্টান পাদরীদের ইসলাম-বিদ্বেষ এবং মুসলিম-বিরোধী প্রোপাগান্ডা খোদ খ্রিস্টান ঐতিহাসিকরাও স্বীকার করেন।

জে জে সান্ডারস লিখেছেন, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, আরবের নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কে খ্রিস্টানরা কখনো আগ্রহ ও সহানুভূতির দৃষ্টিতে দেখেনি। অথচ হযরত ঈসা (আ.)-এর নম্র ও নিষ্পাপ ব্যক্তিত্বই ছিল তাঁর আদর্শ। (ক্রুসেড আমলে) ইসলামের কারণে খ্রিস্টজগতের স্বার্থহানি এবং ক্রুসেডারদের অব্যাহত প্রোপাগান্ডার কারণে ইসলাম সম্পর্কে নিরপেক্ষ বিচার-বিবেচনার পরিবেশ ছিল না। ওই সময় থেকে আজ পর্যন্ত মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)কে অন্যায়ভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে এবং ভিত্তিহীন কথাবার্তা প্রচার করা হয়েছে। সুদীর্ঘকাল যাবত এগুলোই হচ্ছে মুহাম্মাদ সম্পর্কে খ্রিস্টান জনসাধারণের বিশ্বাস। (আহদে উসতা কে ইসলাম কী তারীখ, ৩৪-৩৫)

ডব্লু মন্টগোমারি ওয়াট লেখেন, ‘মুশকিল এই যে, এই উগ্র সাম্প্রদায়িকতা আমরা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছি, যার শিকড় মধ্যযুগের যুদ্ধকালীন প্রোপাগান্ডার মাঝে প্রথিত। এখন তা প্রকাশ্যে স্বীকার করা উচিত। অষ্টম শতাব্দী থেকে ইউরোপের খ্রিস্টজগত ইসলামকে তাদের সবচেয়ে বড় শত্রু ভাবতে থাকে। কারণ তাদের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক আধিপত্যের জন্য ইসলামই ছিল একমাত্র চ্যালেঞ্জ। তারা প্রতিপক্ষের চরিত্রহননের মাধ্যমে তাদের ধর্ম-বিশ্বাসকে টিকিয়ে রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছে। বিংশ শতকের মাঝামাঝিতেও এর জের অবশিষ্ট রয়েছে। (ইসলাম কেয়া হ্যায় পৃ. ২০১)

এই বিদ্বেষ ও প্রতিহিংসাই অমুসলিমদেরকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অবমাননার প্রতি উদ্বুদ্ধ করে। আর বিগত দুই তিন শতাব্দী যাবত ইউরোপ থেকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নামক যে বিষাক্ত মতবাদ প্রচার করা হয়েছে তা দিয়ে রিসালাত-অবমাননার মতো চরম অপরাধকেও বৈধতা দেওয়ার অপচেষ্টা করা হয়েছে। পাকিস্তান একটি মুসলিম-রাষ্ট্র হওয়ার সুবাদে যুক্তিসঙ্গতভাবেই এখানে রিসালাত-অবমাননার শাস্তি মৃত্যুদন্ড। এই আইনের প্রতি পশ্চিমাদের বিষোদগার এবং তা বাতিলের জন্য সরকারের উপর চাপ অব্যাহত থাকলেও আলহামদুলিল্লাহ দেশের নাগরিকদের ভয়ে কোনো সরকার তা পরিবর্তনের দুঃসাহস করেনি।

[জুরমে তাওহীনে রিসালাত : চান্দ পাহলু’ শীর্ষক প্রবন্ধ থেকে গৃহীত।]
***এর পর দ্বিতীয়

Want your school to be the top-listed School/college?

Website