
কেন নিজামুদ্দিন?
-সৈয়দ আনোয়ার আবদুল্লাহ
--------------------------------------
কেন নিজামুদ্দিন ? বা নিজামুদ্দিন বিশ্ব মারকাজ? -এই শিরোনামটি চমক সৃষ্টি কিংবা পাঠক আকৃষ্ট করার জন্যে নয়। ধরণীতে এতো এতো দ্বীনী শাখা আর শোভার ভিড়ে আজো কেন নিজামুদ্দিন আলমি মারকাজ আমাদের কাছে এতো প্রত্যাশিত, এতো প্র্যয়োজনীয়।
দ্বীনের এই বাতিঘরকে কেন শত প্রতিকূলতার ভিতর দিয়ে আকড়ে থাকা? শত ঘাত-প্রতিঘাত মোকাবেলা করে? কেনইবা আজ সারা দুনিয়ার সকল মত পথ, মাযহাব ও মাসলাকের মুসলমান কণ্টকাকীর্ণ বন্ধুর পথ মাড়ি দিয়ে দ্বীনের এই লাইট হাউজকে দেখে পথ চলা? এটি কী কেবলি কোন আবেগ? কিংবা অন্য কিছু?
এই একটি মাত্র দ্বীনী মারকাজকে আকড়ে থাকার কারণে গেল কয়েক বছর স্বগ্রোত্রিয়দের কাছ নির্যাতনের স্টিম রোলার সহ্য করা। কেনই বা এই নিজামুদ্দিনকে মানতে মানতে গেল বছর বিশ্বের হাজার হাজার মুসলমানের কারাভোগ করা। মুসলিম পর্দানশিন নারীদের মাসের পর জেল খাটা। এমনকী কষ্ট নির্যাতন সহ্য করতে করতে মূত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন অনেকেই। কেনইবা খেয়ে না খেয়ে এই মারকাজের তাকাযা পুরণে হাজার লক্ষ মানুষের রাতদিন এতো এতো নজরানা ও কুরবানী৷ কেনই বা জান-মাল ও জীবনের বাজী লাগিয়ে নিজেকে দ্বীনের জন্য বিলিয়ে দেয়া? আর কেনই বা সারা বিশ্বের বাতিল শক্তি দাজ্জালি মিডিয়া আর পরাশক্তির অপপ্রচার ও টার্গেট এখন এই মারকাজকে খতম করা?
আজ থেকে শত শত বছর ধরে এই মারকাজকে কেন্দ্র করে কুরবানীর যে সীমাহীন নযরানা পেশ করা হয়েছে বিশ্বে এর দ্বিতীয় উদাহরণের নজীর কেউ দেখাতে পারবে না। এই মারকাজের ফিকিরে কত পথহারা বান্দা পথের দিশা পেয়েছেন। কত বনি আদম আলোর ফেরিওয়ালা হয়েছেন। কত নর্দামা আর গান্ধিগী জীবন ছেড়ে সত্যের সারথী হয়েছেন এর হিসাব কেবল রাব্বুল আলামিনই জানেন। কত কাফের মুশরিক রাব্বে কাবায় সেজদা দেনেওয়ালা হয়েছেন, ঈমানের বলে বলিয়ান হয়েছেন এটি আজ নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না।
কত শত আল্লাহর বান্দা এই মারকাজের তাকাজায় লাব্বাইক বলে দ্বীনের জন্য দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর আপন পরিবার পরিজন স্ত্রী পুত্র-কন্যা রেখে আল্লাহর রাস্তায় দেশ থেকে দেশান্তরে ছুটে চলেছেন, আর সেখানেই আপন কবর রচনা করেছেন। কেন আল্লাহর রাস্তায় শাহাদতের তামন্না নিয়ে এই আত্মত্যাগ?
জগতজুড়ে এই আত্মত্যাগ আর কুরবানী কেনই বা নিজামুদ্দিন মারকাজকে ঘিরে এটি আজ অনেকটা স্পষ্ট বিশ্ববাসীর সামনে। তবে যারা দাওয়াতের কাজের ব্যাপারে পূর্ণ ওয়াকিবহাল নন, কিংবা এসব বিষয়ে জানাশোনার গন্ডি সীমিত তাদের কাছে নিজামুদ্দিন মারকাজের এই অনিবার্যতা আশ্চর্যের! বড়ই বিস্ময়ের?
একবিংশ শতাব্দির মহান সংস্কার আল্লামা সাইয়্যেদ আবুল হাসান আলী নদভী রহ লিখেছেন, কোন ধরনের চাটুকারিতা ও মিথ্যার আশ্রয় না নিয়ে যে বাস্তাব কথাটি আজ সবার সামনে অপকটে বলা যায় তাহলো, বর্তমান সময়ে মুসলিম বিশ্বের সর্ববৃহৎ ও বিস্তৃত, সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী ও উপকারী দাওয়াতের নাম হলো তাবলীগ জামাতের দাওয়াত। এই দাওয়াতের মারকাজ হলো দিল্লীর নিজামুদ্দিনে অবস্থিত তানলীগের মারকাজ। ( ভুমিকা, মুন্তাখাব হাদীস)
ভারত মনীষা মাওলানা ওয়াহিদুদ্দিন খান রহ. তাবলীগী তাহরীক নামক গ্রন্থে তার স্মৃতি কথায় লিখেছেন, “আজ নিযামুদ্দিন একটি জাতীয় ; বরং আন্তর্জাতিক বিপ্লবের কেন্দ্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এ জায়গাটির দৃষ্টান্ত হলো হৃৎপিন্ডের মতো। হৃৎপিন্ড থেকে যেমন রক্ত প্রবাহিত হয়ে পুরো শরীর ঘুরপাক খেয়ে আবার হৃৎপিন্ডে ফিরে আসে , তেমনি অসংখ্য মানুষ এখান থেকে বের হয়ে দুনিয়ার আনাছে- কানাছে ছড়িয়ে পড়ে। ফিরে এসে নতুন শক্তি শঞ্চয় করে এবং দ্বিতীয়বার নিজেদের তাবলিগী মিশন নিয়ে বেরিয়ে পড়ে ।এখানে এমন এক বিপ্লবের খোঁজ পাওয়া যায় ,যার শুরু আছে; কিন্ত শেষ নেই।”
দারুল উলুম দেওবন্দের ছদরুল মুদাররিসিন ,আমিরুল হিন্দ উলাদে রাসুল সািইয়্যেদ আরশদ মাদানী দা.বা. কে গতবছর এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিল, অনেকেই বলছেন, নিজামুদ্দীনে করোনার সময় এমন অনুষ্ঠান না করলে কী হতো? সাইয়্যেদ আরশাদ মাদানী তার উত্তরে বলেন : এটি আজকের নতুন কোন বিষয় নয়। এরকম অনুষ্ঠান শত বছর ধরেই নিজামুদ্দীনে হয়ে আসছে প্রতিদিন। আমি হযরতজী ইলিয়াস [রহ.] এর জামানায় আব্বা হযরতের (কুতবে আলম শায়খুল ইসলাম সৈয়দ হোসাইন আহমদ মাদানী রহ.) সাথে বহুবার নিজামুদ্দীন গিয়েছি। তখনো মেওয়াতিরা সেখানে নিয়মিত আসতো। বড় বড় মজলিস হতো। এখনো নিজামুদ্দীন মার্কাজ থেকে হাজারো দেশ-বিদেশের জামাত নিয়মিত আসা-যাওয়া করে। এটি মার্কাজের সাধারণ নিয়ম। মিডিয়া সেটিকে সমাবেশ নাম দিয়েছে মার্কাজ বা তাবলীগ সম্পর্কে কোন ধারণা না থাকায়। সারা দুনিয়ার লাখ লাখ মুসলমান তাবলীগের মাধ্যমে দ্বীন শিখতে নিজামুদ্দীন মার্কাজে শত বছর ধরে এভাবেই আসা-যাওয়া করছে। বছরের পর বছর ধরে একই উপায়ে তাবলীগে তারা বিভিন্ন জামাতের সাথে বিশ্বের বিভিন্ন শহরে যায়।
#সাংবাদিক আবার প্রশ্ন করেন, তাবলীগের বিভক্তির পরেও কী সেরকম অবস্থা নিজামুদ্দীন মার্কাজে আছে?
সাইয়্যেদ আরশাদ মাদানী তখন উত্তরে বলেন: কেন থাকবে না। নিজামুদ্দীন তো তার আগের জায়গায়ই আছে। দু’একজন চলে গেলে মূল প্রতিষ্ঠানের প্রভাব কখনো বিনষ্ট হয় না। দারুল উলূম থেকে অনেকেই চলে গেছেন, বড়বড় হাস্তিরা নানান বড়বড় অভিযোগ নিয়ে, আলাদা মাদরাসা করেছেন, কই দারুল উলূম তো তার আগের জায়গাই আছে। এই মার্কাজে ইলিয়াস [রহ.] সহ অসংখ্য আকাবির-বুজুর্গদের কুরবানী, চোখের পানি আর কুরবানী আছে। এটি এমনি এমনি কী নষ্ট হয়ে যাবে? এর সাথে মকবুলিয়াতের সম্পর্ক আছে। যারা চলে গেছেন আমি আশা করি, সেসব বুজুর্গরাও আপোসে এখতেলাফ মিটিয়ে মার্কাজে আবার চলে আসবেন।"
আমরা যারা নিজামুদ্দিন নিয়ে র্চচা ও গবেষনা করি তাদের অনেকেরই এই ইতিহাস জানা আছে এই মারকাজিয়তকে ধবংস করতে ১৩বার বিদ্রোহ হয়েছে। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা এই মারকাজকে আপন কুদরত দ্বারা হেফাজত করেছেন। ইনশাল্লাহ ইমাম মাহদী আ. আসার আগ র্পযন্ত এটিই উম্মোহ বিনির্মানে মিল্লাতের সবচেয়ে বড় মারকাজ বা কেন্দ্র অথবা সদর দপ্তর হিসাবে ঠিকে থাকবে ইনশাল্লাহ। দ্বীনের ঐক্যবদ্ধ কাজের জন্য মারকাজিয়্যাত বা একটি কেন্দ্র থাকার অপরিহার্য দাবী এটি দ্বীনী মেহনতের বুনিয়াদী উসুল। সীরাতের অপরিহার্য একটি অধ্যায়। ইসলামের মৌলিক জীবনাচারের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
মাওলানা সাঈদ আহমাদ খান রহ. বলেন, দাওয়াতের সাথীদের উচিত, নিজেদেরকে মারকাজের সাথে জুড়ে রাখা। মূূল মারকাজ একটিই হয়। মূল মারকাজের অধীনে অনেক শাখা হয়। যেমন খোলাফায়ে রাশেদার যুগে মদীনা মুনাওয়ারা মারকাজ ছিল। আমীর ও খলিফার অবস্থানস্থলও ছিল মদীনা। তেমনিভাবে আমাদেরও মারকাজ হচ্ছে নিজামুদ্দীন। এই মারকাজের সাথে প্রত্যেক পুরাতন ও নতুন সাথীর সম্পর্ক রাখা একান্ত আবশ্যক। সেখানকার নির্দেশনা নিয়েই চলা উচিত। (সাইদ আহমাদ খান রহ. পত্রাবলী : পৃষ্ঠা ৪/৩৭০)
পাকিস্তানের হাজী আব্দুুল ওয়াহাব রহ. বলতেন, "মাওলানা ইলিয়াস রহ দাওয়াতের কাজকে আল্লাহ তায়লার কাছে কবুল করিয়েছেন, যার ফলে মানুষ ঘরে ঘরে পাইতেছে, তাই এ কাম আগে বাড়তেছে। নিযামুদ্দিনের মাটিকেও আল্লাহ তায়লার কাছে কবুল করাইয়াছেন! এই কাজ দুনিয়াতে ততদিন পর্যন্ত চলবে, যতদিন পর্যন্ত নিযামুদ্দিন থেকে হরকতটা চালু থাকবে, দাওয়াতের আলমি কাজ সারা দুনিয়ায় কাম টিকাইয়া রাখার আর কোনো জায়গা নাই!
(এর অডিও রেকর্ড উমর ফারুক সাহেবের যবানে এখনো সংগ্রহিত আছে আমাদের কাছে।)
হে আল্লাহ; নিজামুদ্দিন মারকাজকে কেয়ামত পর্যন্ত দায়েম ও কায়েম রাখো, এই মারকাজ ও মারকাজের আমীর ও, সকল জিম্মাদার ও এর সাথে জুড়ে থাকা সারা দুনিয়ার তাবলীগের সাথীদের হেফাজত করুন। কবুল করুন।